পাবনার গ্রাম থেকে বিদেশে গিয়ে ফেরেনি কেউ
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/06/11/photo-1433993849.jpg)
পাবনা-চাটমোহর সড়কের শিমুলতলা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে গেলে বন্যাগাড়ি গ্রাম। চিকনাই নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা অপেক্ষাকৃত শান্তশিষ্ট মূলগ্রাম ইউনিয়নের এই গ্রাম। এই গ্রামেরই জামাত আলীর ছেলে তানজীল হোসেন। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল সে। একটি পরীক্ষা বাকি থাকতে বিদেশ যাওয়ার জন্য স্থানীয় দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে। এর পর থেকেই আহাজারি থামছে না তাঁর মা মোমেনা বেগমের।
একই গ্রামের জুব্বার আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম স্ত্রী ও নয় মাস বয়সী শিশুকন্যা রেখে অর্থ উপার্জনের আশায় পাড়ি জমান বিদেশে। কিন্তু প্রায় চার মাসে তাঁরও কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনরা। একই অবস্থা গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে শুকুর আলী, আবদুর রশিদের ছেলে জুয়েল, সাইফুল ইসলামের ছেলে জাহিদুল, আটলংকা গ্রামের নুরাই হোসেনের ছেলে হোসেন আলী ও মূলগ্রাম পুকুরপাড়া গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে জাকির হোসেনের।
সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর আশায় স্বল্প খরচে বিদেশে পাড়ি জমানোর লোভ সামলাতে না পেরে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে নিখোঁজের তালিকায় যোগ হয়েছে চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের এই সাত যুবক। দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস ধরে কোনো খোঁজ না পাওয়ায় নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের। সমুদ্রপথে অবৈধভাবে থাইল্যান্ড হয়ে ইন্দোনেশিয়া যাওয়া এসব যুবককে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি স্বজনদের।
সম্প্রতি সরেজমিনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যাগাড়ী গ্রামের স্থানীয় দালাল শরীফ ও সুজন প্রথমে ২০ হাজার টাকা নিয়ে পাচারকারী চক্রের সহযোগিতায় প্রথম ধাপে তিনজনকে, পরে দ্বিতীয় ধাপে আরো চারজনসহ মোট সাতজনকে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠায়। সেখানে নির্যাতন চালিয়ে মোবাইল ফোনে আরো টাকা দাবি করে পাচারকারীরা। পরে জনপ্রতি প্রায় এক লাখ টাকা করে পাঠায় তাঁদের পরিবার। কিন্তু তার পরও তাঁদের খোঁজ না পেয়ে হতাশ স্বজনরা। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গল ও সমুদ্র থেকে হাজার হাজার অভিবাসীকে জীবিত ও মৃত উদ্ধারের খবরে আতঙ্ক বিরাজ করছে নিখোঁজদের পরিবারের স্বজনদের মধ্যে।সাংবাদিক এসেছে শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন নিখোঁজ তানজিলের মা মোমেনা খাতুন। হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমার ছেলে তানজিল এসএসসি পরীক্ষা দিছিল, আর একটা পরীক্ষা আছিল। সেই ছেলেডাক ওই শরীফ আর সুজন বিদেশের লোভ দেখায়। চার দিনে লাউ ছাড়বি, সাত দিনে ইন্দোনেশিয়া পায়া যাবু—এই কথা কয়া আমার ছেলেডাক লিয়ে গেল। এত কইরে কল্যাম, শুনল লায় আমার কথা। এহন আমার তানজিলেক পাচ্ছি না রে বাবা, আমার তানজিলেক আইনে দাও।’
নিখোঁজ শুকুর আলীর মা সুফিয়া বেগম বলে, ‘প্রথম ২০ হাজার টাকা দিয়ে আমার ছেলেটাকে নিয়ে যায় মিয়ানমারে। সেখান থেকে আমার ছেলে ফোন করে জানায়, খুব বিপদে আছি, তাড়াতাড়ি টাকা পাঠাও। পরে তিনজনের জন্য আড়াই লাখ টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু এর পরও কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।’
রফিকুল ইসলামের স্ত্রী শাপলা খাতুন বলেন, ‘আমারে কাউক কিচ্ছু না কয়া একদিন সকাল ৮টায় বাড়িত থ্যাকি চইলে গ্যালো। পরে ফোন দিয়ে কইছিল, সে নাকি বিদেশ যাচ্ছে। কিন্তু তার পর আর কোনো খোঁজখবর পাইনি। কীভাবে আছে, কী খাচ্ছে, কিচ্ছু জানি না।’
নিখোঁজ জুয়েলের বাবা আবদুর রশিদ, জাহিদুলের দাদি ফুলকুমরী বেগম, শফিকুলের ভাই রফিকুল ইসলাম একই অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, ‘আমরা খুব চিন্তায় আছি। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমাদের সন্তানদের দ্রুত উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। ’ এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য দালাল চক্রের সদস্য শরীফের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। স্বজনরা দালালদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়ালেও রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
তবে জেলার মানবপাচার বা নিখোঁজদের বিষয়ে কোনো তথ্য জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে নেই। পাবনা জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দেবব্রত ঘোষ বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত পাবনা থেকে মানবপাচারের কোনো অভিযোগ পাইনি। এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।’
পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় উদ্ধার হওয়া জীবিত অভিবাসীদের মধ্যে পাবনা জেলার ৩৮ জনের খোঁজ মিলেছে। সরকারের নির্দেশে আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সত্যতা পেয়েছি। এ তালিকায় নাম আরো বাড়তে পারে। উদ্ধারকৃতদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে সরকার।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার পর পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারব।’
এদিকে, চাটমোহর ছাড়াও জেলার সুজানগর উপজেলার উলাট গ্রামের মোমিন শেখের ছেলে বাচ্চু শেখ, বারেক শেখের ছেলে বাকি শেখ, মান্নান শেখের ছেলে সাদ্দাম শেখ ও আত্তাপ শেখের ছেলে হানিফ শেখ দালালের মাধ্যমে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন।