দুই চালকের সাজার প্রতিবাদে টানা দুদিন সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘটে সাধারণ মানুষ নাকাল হওয়ার মধ্যে মন্ত্রীর ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণার পর বিকেলে থেকে রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার পথে বাস চালানো শুরু করেছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।

আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভবনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। বৈঠকে জাতীয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। মশিউর রহমান রাঙ্গা বাস ও ট্রাকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি।

বৈঠক শেষে নৌপরিবহনমন্ত্রী ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের মোর্চা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ঘোষণায় বলেন, ‘সরকার আইনানুগ সম্ভাব্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। মাননীয় মন্ত্রীদ্বয়ের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সব সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের চলমান অচলাবস্থা নিরসনকল্পে যানবাহন চলাচলের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’

পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রসঙ্গে নৌপরিবহনমন্ত্রী পরিবহন শ্রমিক নেতাদের বলেন, ‘বুধবার সকালে সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো আইনগতভাবেই সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

তারপরই বিকেল সোয়া ৩টা থেকে রাজধানীর গুলিস্তান, গাবতলীসহ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়ি ছাড়া শুরু হয়।

গুলিস্তান থেকে মাওয়াগামী ইলিশ পরিবহন, নারায়ণগঞ্জ রুটের বিভিন্ন গাড়ি ও কুমিল্লার দাউদকান্দিগামী গাড়ি ছেড়ে যেতে দেখা যায়। গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় যাত্রীরা স্বস্তিবোধ করছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও বাস চলাচল শুরু হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. আশরাফ উদ্দিন বিকেলে রাজধানীর গাবতলীতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসার পর পরই আমরা গাবতলী থেকে যানবাহন চালানো শুরু করেছি। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ইউনিয়ন দেখবে।’

বিকেলে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন খুলনা বিভাগীয় কমিটির সভাপতি আজিজুল আলম মিন্টু এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিছু গাড়ি চলছে। অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

ঢাকা থেকে মাওয়াগামী ইলিশ পরিবহনের চালকের সহকারী রোকন বলেন, ‘অবরোধ শেষ, তাই গাড়ি চালাচ্ছি। এখন গাড়ি মাওয়ার উদ্দেশে যাবে।’ তবে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

হামিদ নামের একজন যাত্রী বলেন, ‘আমি ফরিদপুর যাব। তাই গুলিস্তানে এসেছি। গাড়ি চলছে শুনে শান্তি লাগছে।’

এদিকে গাবতলী থেকেও রাজধানীর অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার পথে যানবাহন চলতে শুরু করেছে। সকাল থেকে যাঁরা বাসস্ট্যান্ডে বসেছিলেন, গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় তাঁদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে দূরপাল্লার গাড়িগুলোর কাউন্টার ধীরে ধীরে খুলছে। ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর গাড়ি চলাচল শুরুর প্রথম দিকে সাধারণ কিছু শ্রমিক এসে বাধা দেয়। পরে শ্রমিক নেতারা এসে সাধারণ শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।

যশোর থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসার পর পরই যশোরের বিভিন্ন রুটে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বিকেল ৪টায় যশোর মণিহার বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকাগামী ও অভ্যন্তরীণ পথের গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার মামলায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে চুয়াডাঙ্গা ও পরে যশোর বিভাগে ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা।

এ ধর্মঘট চলাকালেই সাভারের ট্রাকচালক মীর হোসেন মীরুকে একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তারপর কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই গতকাল মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।

ধর্মঘট চলাকালে গতকাল রাতে গাবতলীতে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। আজ সকালেও সংঘর্ষ হয়। যাত্রীদের দুর্ভোগ এই সময়ে চরমে ওঠে। রাজধানী ঢাকায় সকাল থেকে বিআরটিসি বাস, পিকআপ, প্রাইভেট কার, টেম্পো, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া কোনো গণপরিবহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে দু-একটি ৮ নম্বর বাস চোখে পড়েছে। সকাল থেকে সড়কগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা।

এই পরিস্থিতি অফিসগামী হাজারো মানুষের জন্য বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে দূর গন্তব্যের অফিসগামী যাঁরা নিয়মিত বাসে যাতায়াত করেন, বাস না পেয়ে তারা রীতিমতো নাকাল হয়েছেন। পরিবহন না থাকার কারণে তাদের হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা হেঁটে গন্তব্যে যেতে পারলেও দূরপাল্লার যাত্রীদের চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে।

রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে সরেজমিনে দেখা যায়, আন্তজেলার সব বাস কাউন্টারগুলো দুপুর পর্যন্ত বন্ধ ছিল। পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় অবস্থান করে। যাত্রীবাহী বাস তারা চলাচল করতে দেয়নি।

এর মধ্যে দুপুরে এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে অবরোধকারীদের বিষয়ে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে রুল জারি করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদের করা রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি সৈয়দ মো. দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আদেশসহ রুল জারি করেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আজ বুধবার দুপুরে নৌপরিবহনমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ধর্মঘট প্রত্যাহারের জন্য পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান। তার পরই অবসান ঘটে পরিবহন ধর্মঘটের।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের জোকা এলাকায় বিপরীতগামী যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় একটি মাইক্রোবাসের। এতে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে।