হানিফের বক্তব্যে সমালোচনা
‘নিহত প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক তাঁর সন্তানের হত্যাকারীদের আদর্শে বিশ্বাসী। এ কারণেই তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান না’- আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফের এমন বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে এ ধরনের বক্তব্যে মর্মাহত হয়েছেন। আবার অনেকে ‘বিনয়ের সঙ্গে এ ধরনের বক্তব্য প্রত্যাহার করার জন্য’ আওয়ামী লীগের নেতার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
urgentPhoto
গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনী সংস্থার কার্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। দুর্বৃত্তরা তাঁকে নির্মমভাবে কুপিয়ে কার্যালয়ের দরজা বন্ধ করে চলে যায়। পরে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ফয়সল আরেফিন দীপনের প্রকাশনা সংস্থা থেকেই নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়েছিল।
শোক বিহ্বল নিহত দীপনের বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক ছেলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। এখানে আমি বিচার চাই না। জানি, বিচার চেয়ে কোনো প্রতিকার হবে না।’
দীপনের বাবার এ বক্তব্য গণমাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়।
আর আজ রোববার এর প্রতিক্রিয়ায় হানিফ বলেন, ‘একজন ছেলেহারা বাবা তাঁর সন্তান হত্যার বিচার চান না। এই প্রথম বাংলাদেশে এ রকম একটা ঘটনা দেখলাম। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি যে, কোনো বাবা তাঁর ছেলের হত্যার বিচার চান না। আমার মনে হয়, এর কারণ একটাই, ছেলেহারা বাবা অধ্যাপক সাহেব হয়তো ওই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উনি তাঁর দলের লোকজনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাননি বলেই হয়তো এ কথা বলেছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। আমিও একজন বাবা। বাবা হিসেবে আমি তাঁর এই বক্তব্যের জন্য লজ্জিত।’
হানিফের এ বক্তব্য ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনা শুরু হয়। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। সেখান থেকে কিছু মন্তব্য এখানে তোলা ধরা হলো।
চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, ‘এই এমন এক নিদান কাল যখন কারো কারো গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের সাথে না মিললে, এমনকি সন্তানহারা বাবাকেও প্রকারান্তরে খুনের সহযোগী বানিয়ে ফেলা যায়।’
‘এগুলো না বলে দয়া করে অপরাধীদের ধরেন, বিচার করেন। এই পর্যন্ত যতগুলো অপরাধ হয়েছে, সেগুলোর বিচার করেন। এই উত্তেজনা প্রশমনের কার্যকর ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি সমাজের যেসব সুতোয় টান লেগেছে সেগুলো ঠিক করেন।’ যোগ করেন জনপ্রিয় এ নির্মাতা।
টিভি উপস্থাপক অঞ্জন রায় এ ধরনের বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, ‘বিনীতভাবেই অনুরোধ করতে চাই মাহাবুব-উল-আলম হানিফকে, আপনার বক্তব্যটি প্রত্যাহার করুন। আর সোচ্চার হোন শুধু দীপন নয়, উগ্রবাদীদের হাতে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে।
একই কথা বলেছেন সাংবাদিক প্রণব সাহা।
চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান লিখেছেন, ‘মাহাবুবুল আলম হানিফ যদি আদৌ দর্শন শব্দের অর্থ বুঝে থাকেন তাহলে তার জীবনের দর্শন হয়তো তাই: ক্ষমতা মানেই টাকা আর সেই ক্ষমতা আর টাকার জন্য নিজের সন্তানকেও কোরবানি করা যায়।’
একাত্তর টেলিভিশনের সংবাদ প্রধান সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা লিখেছেন, ‘মাহবুব উল আলম হানিফ, বুঝতে পারছি, যা বলেছেন তা-ই আপনার মূল্যবোধ..’
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক ফজুলল বারী বলেছেন, ‘একি কথা বললেন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বিতাড়িত আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফ! দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক যিনি সারা জীবন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রবক্তা, তিনি ধর্মান্ধ খুনিদের পক্ষের লোক? অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় কি পুত্রহত্যার বিচার পেয়েছেন? কেন আজ চুপ মেরে গেছেন চির প্রতিবাদী এক কণ্ঠস্বর অজয় রায়? এসব দেখেশুনেই কি এমন বক্তব্য দেননি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার? একজন শোকার্ত পিতাকে এভাবে আক্রমণ না করলে কি চলত না হানিফ সাহেব? ক্ষমতার কারণে গত কয়েক বছরে তো আপনি টাকার কুমির হয়েছেন। আর অজয় রায়ের পর আবুল কাসেম ফজলুল হক হয়েছেন সন্তানহারা। উনি তো আপনাদের কাছে টাকা-চেক কিছু চাননি। সন্তানহারা এক পিতাকে নিরীহ নিজের অসহায়ত্বের কথাও বলতে দেবেন না?’
এনটিভি অনলাইন এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করলে ফেসবুক ফ্যান পেজে শরীফ মোহাম্মদ তাহসিন নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘উল্টা-পাল্টা কথা বলা রাজনীতিবিদদের নেশা-পেশা দুটোই। সরকারের ওপর জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে কী বিচার চাইবে? কার কাছে বিচার চাইবে? বিচার তো হয় না। যেটা হয়, সেটা হচ্ছে, লঘু পাপে গুরু দণ্ড। দুর্বলের বিচার হয়, সবলের হয় না।’
দুর্বা রায় নামের একজন লিখেছেন, ‘হানিফ সাহেব... আপনি রাজনীতিবিদ হতে পারেন কিন্তু আপনি শিক্ষাবিদ নন... আর রাজনীতিবিদের চেয়ে শিক্ষাবিদের বিবেক, হৃদয়, মহত্ব অনেক বেশি... আমি হলফ করে বলতে পারি যে স্যারের কথা পুরো জাতি শ্রদ্ধার সাথে অবনত চিত্তে সমর্থন করে- শুধু আপনারা ছাড়া...।’
মোহাম্মদ ফারুক লিখেছেন, ‘দীপনের বাবা বুঝে গেছেন ছেলে হত্যার বিচার কোনোদিন-ই পাবেন না।’
আল আমিন ইসলাম অমি মন্তব্য করেছেন, ‘উনি (দীপনের বাবা) জানেন যে, সাগর রুনি হত্যার বিচার হয়নি, এটাও হবে না। আর তদন্ত হলেও লোক দেখানো। তাই কষ্টে চাননি বিচার। আপনি (হানিফ) কী বুঝবেন সন্তান হারানোর কষ্ট।’
মো. হেলাল চৌধুরী বলেছেন, ‘এই পর্যন্ত এতগুলো মানুষ খুন হলো, তোমার সরকার কি আদৌ প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করতে পেরেছে?’
কমল হাসান লিখেছেন, ‘রাজনীতির জন্য এই হতভাগ্য পিতাকেও ছাড়লেন না। এমনই যদি হয় আমাদের রাজনীতিবিদদের মানসিকতা, তবে ওনারা আমাদের জন্য, দেশের জন্য কী করবেন?’
দীপাঙ্কর কুণ্ডু মন্তব্য করেছেন, ‘হত্যাকারীদের সাথে দীপনের আদর্শিক মিল থাকলে তো খুন হতো না। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের কোনো অগ্রগতি সরকার দেখাতে পারেনি ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও।’
জার্মান প্রবাসী ফারজানা কবীর খান লিখেছেন, ‘হানিফের বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয়- কারা এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত!! কেন খুনিদের ধরার পরও ছেড়ে দেওয়া হয়। খুনিকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়ার পর কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুনির নাম প্রকাশ করে না। জেনে রেখ- সত্য কখনো চাপা থাকে না।’