পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে শান্তিচুক্তির ১৮ বছর উদযাপন!
পার্বত্য শান্তিচুক্তির দীর্ঘ ১৮ বছরেও শান্তি আসেনি পাহাড়ে। ১৯৯৭ সালের আজকের দিনে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এই চুক্তি করলেও দেশের পার্বত্যাঞ্চলে এখনো থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। এমনকি চুক্তির বর্ষপূর্তি উদযাপনের এই দিনেও পাল্টাপাল্টি নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে পাহাড়ের দুটি প্রধান দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই ইউপিডিএফ ও সম-অধিকার আন্দোলন শান্তিচুক্তি বাতিল ও চুক্তি সংশোধন আর জেএসএস চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি করে আসছে। দুই প্রধান আঞ্চলিক দলের পাল্টাপাল্টি আন্দোলন আর সংঘাতে আজও উত্তাল পাহাড়ি জনপথ।
চুক্তির পক্ষে অবস্থানকারী জনসংহতি সমিতি ‘শান্তিচুক্তির ১৮ বছর পূর্তি’ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র্যালি, সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। অপরদিকে চুক্তি বাতিলের দাবিতে সম-অধিকার আন্দোলনসহ অন্যান্য বাঙালি সংগঠনগুলো কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমাসহ জেএসএস নেতাদের দাবি জুম্ম জনগণ ও পার্বত্যাঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বহু বছরের আন্দোলন সংগ্রামের পর শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেও এই ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শান্তিচুক্তির ধারা অনুযায়ী জেএসএস সব শর্ত পূরণ করলেও সরকার করেনি। আর তাই সরকারের উচিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা।
বিষয়টি নিয়ে জেএসএস জেলা সাধারণ সম্পাদক ও রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যবামং মারমা বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে জেএসএস। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সরকারের চুক্তিবিরোধী কর্মকাণ্ডগুলো সামাজিকভাবে বর্জন কর্মসূচি চলছে। চুক্তি বাস্তবায়নের নামে সরকার নানা ধরনের টালবাহানা করছে। সরকার এখনো চুক্তির মৌলিক দিকগুলো বাস্তবায়ন করেনি। উল্টো চুক্তিবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো।’
অপরদিকে শান্তিচুক্তি বাতিল, পাহাড়ি-বাঙালি সমান অধিকার নিশ্চিত এবং ভূমি জটিলতা নিরসন ছাড়া পার্বত্যাঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলে দাবি করেছেন সম-অধিকার আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে শান্তিচুক্তির মৌলিক ধারাগুলোর সংশোধন জরুরি বলে দারি করেছে পার্বত্য চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ।
জেলা ইউপিডিএফ সভাপতি ছোটন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি বর্তমানে মৃতপত্রে পরিণত হয়েছে। চুক্তির ফলে আওয়ামী লীগ সরকার এবং জেএসএসের কিছু লোক লাভবান হলেও যে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য চুক্তি করা হয়েছিল, সেই পাহাড়িদের কোনো পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ফলে পাহাড়িদের জন্য চুক্তির সফলতা আনেনি, এটি বিফলতাই বলা চলে।’
সম-অধিকার আন্দোলন পরিষদের জেলা সভাপতি সেলিম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য শান্তিচুক্তি করা হলেও পাহাড়ে শান্তি আসেনি। চুক্তির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি, পার্বত্যাঞ্চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি এখনো থামেনি। চুক্তির মৌলিক অনেকগুলো ধারা বাস্তবায়নের পরও পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করে চলেছে অস্ত্রধারীরা।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি বলেন, ‘১৯৯৭ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেশের মাটিতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিল। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার তিন পার্বত্য জেলা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে, এটিও শান্তিচুক্তির একটি ফসল। পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করেছে। শান্তিচুক্তি অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। সেগুলো বাকি রয়েছে সেগুলোও বাস্তবায়ন করা হবে। চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক সরকার। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে চুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে।’
এদিকে বরাবরের মতো এবারও সরকারিভাবেও পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে দিনটি উপলক্ষে শোভাযাত্রার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সকালে স্থানীয় রাজারমাঠ থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হবে।
এরপর সন্ধ্যায় জেলা পরিষদের আয়োজনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি। অনুষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে জনসংহতি সমিতির শান্তি বাহিনীর সদস্যরা। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় দুই হাজার শান্তি বাহিনীর সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এরপর অস্ত্র সমর্পণ করা শান্তি বাহিনীর সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছিল।

আলাউদ্দিন শাহরিয়ার, বান্দরবান