খালেদা জিয়ার মামলার শুনানিতে যা হলো

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার শুনানিতে আইনজীবী ও বিচারকের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও আপনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। জুরিসডিকশন কী তা আপনাকে বোঝাব।’ উত্তরে বিচারক বলেন, ‘এটা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আইনি সময় নষ্ট না করে মূল কথা বলেন।’ এ সময় আদালতে উভয় পক্ষের আইনজীবীরা হৈ চৈ শুরু করেন।
আজ বুধবার ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত ৩-এর অস্থায়ী এজলাসকক্ষে খালেদা জিয়ার মামলার শুনানি চলাকালে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এর আগে, সকাল ১১টা ২০ মিনিটে মামলার শুনানি শুরু হয়। খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা মূলত চারটি আবেদন দিয়েছি। এর মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদনের বিষয়ে কথা বলতে চাই।’
এ সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলকে আদালত বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কী?’
কাজল বলেন, ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর আত্মসর্মপণ না করে বা গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির না করা পর্যন্ত এ ধরনের আবেদন করা যায় না। ফৌজদারি কার্যবিধিতে এ ধরনের কোনো নিয়ম আছে বলে আমার জানা নেই।’
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী আদালতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘পরোয়ানা প্রত্যাহারের বিষয়ে আমি আইনি ব্যাখ্যা দেব। আমাকে কথা বলার সুযোগ দেন। আমাকে আমার মতো বলতে দিন।’ এ সময় তিনি ১৯৫৩ সালের ভারতের হায়দরাবাদে মোজাফফর হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলা এবং আমাদের দেশেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের উদাহরণ দেন।
এ সময় আদালত আসামির অনুপস্থিতিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা যায় কিনা সে বিষয়ে কথা বলতে বলেন।
জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বিচারকের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে বেগম খালেদা জিয়া যে আবেদন করেছেন, তা উচ্চ আদালতে বিচারধীন রয়েছে। সে অবস্থায় আপনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন না। আপনি আদেশে বলেছেন, খালেদা জিয়ার হাজির হওয়ার জন্য ৬৩ বার আপনি আদেশ দিয়েছেন।’ আদালতকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনি ভুল তথ্য দিয়েছেন। এ ভুল তথ্য মিডিয়াগুলো খারাপভাবে লুফে নিয়েছে। আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি সময় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে মামলার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও গত ২৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আইনের পরিপন্থী।’
এ সময় আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি শুধুমাত্র গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা দেন।’
এ সময় এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আপনার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে আবেদন করার পরও আপনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আপনি এখতিয়ারবহির্ভূত আদেশ দিয়েছেন। জুরিসডিকশন কী তা আমি আপনাকে বোঝাব।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘এটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এখানে আপনি ক্লাস নিতে আসেননি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর তা প্রত্যাহার করার বিষয়ে আবেদন করেছেন, তা শুনানি করার জন্য আপনার আইনি বৈধতা আছে কিনা তা জানান।’ এ সময় আদালতের ভেতরে অবস্থান করা উভয় পক্ষের আইনজীবীরা হৈ চৈ শুরু করে দেন।
খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বিচারককে উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি একজন সিনিয়র আইনজীবীকে অপমান করেছেন। উনি যখন সুপ্রিম কোর্টে শুনানি করেন, তখন প্রধান বিচারপতিসহ সকল বিচারপতি মনোযোগ দিয়ে শোনেন। সারা দেশে মাত্র ৪৩ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রয়েছেন। তার মধ্যে তিনি অন্যতম। আপনি ওনাকে অপমান করার মাধ্যমে সব আইনজীবীকে অপমান করেছেন। আপনার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কাছে আমি ভিযোগ দায়ের করব।’
এ সময় ঢাকা জেলা আদালতের নবনির্বাচিত আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাসুদ আহমেদ তালুকদারের সহযোগিতায় উভয় পক্ষ শান্ত হয়।
পরে ব্যারিস্টার এ জে মোহাম্মদ আলী আবারও শুনানি শুরু করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া নিরাপত্তার অভাবে আদালতে আসতে পারেননি। তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁর বাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বুন্দক নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁকে মারার জন্য। এর আগে আদালতে আসার সময় তাঁর গাড়িতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা হামলা করেছে।’
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আপনি শুনানির সমাপ্তিতে আসেন।’
এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে পাঁচজন বিচারপতি রয়েছেন, যাঁরা আমি শুনানির সময় কখনো ডিস্টার্ব করেননি। আপনি আমাকে শুনানিতে বাধা দিচ্ছেন।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘এ বিষয়টি আপনি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন।’
ব্যারিস্টার এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সাবমিশন করা মানে আপনাকে শিক্ষা দেওয়া নয়। আইনি বিষয় আপনি জানেন। কিন্তু আইনজীবী হিসেবে এগুলো তুলে ধরা আমার দায়িত্ব। আমরা চোখ-কান খোলা রেখেছি। আপনি ন্যায়বিচার করবেন, আমাদের আবেদন গ্রহণ করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেবেন বলে আশা করি।’
অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির কোথাও আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এ ধরনের আবেদনের সুযোগ নেই। আসামিকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে অথবা গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার পর এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে। সুতরাং তাদের আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হোক।’
এরপর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতির দুটি মামলার শুনানি আগামী ৫ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল রেখে এর বিরুদ্ধে করা আবেদনটি নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেন।