বাংলাদেশের রাজনীতি : ফুটন্ত অবস্থায়

‘শেষের খেলা শুরু হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এ সপ্তাহে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে যে খেলা শেষ হতে আরো সময় লাগবে।’ বাংলাদেশ সম্পর্কে করা প্রতিবেদন এভাবেই শুরু করেছে যুক্তরাজ্যের সাপ্তাহিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট।
‘পলিটিকস ইন বাংলাদেশ : অন দ্য বয়েল’ শিরোনামের এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। শিরোনামটির বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি : ফুটন্ত অবস্থায়’।
৫ মার্চ প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়; অনেকেই ধারণা করেছিলেন, এ সপ্তাহেই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করবে। বেগম জিয়া শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরম শত্রুই নন, দৃশ্যত বর্তমান সরকারের সর্বশেষ প্রতিপক্ষও।’
‘গত দুই মাসে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যকার বিরোধ চরম অবস্থায় পৌঁছানোয় মানুষ প্রশ্ন করা থামিয়ে দিয়েছে যে, শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে বন্দী করবেন কিনা। এখন তারা কেবল জিজ্ঞেস করছে, কখন (বন্দী করা হবে)। গত ৪ মার্চ এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন আদালত- এখনই নয়। ওই দিন আদালত খালেদা জিয়ার মামলার শুনানি এক মাসের জন্য স্থগিত করেন।’
‘বেগম জিয়ার মামলার শুনানি স্থগিতের সিদ্ধান্ত যতটা না বিচার বিভাগের বিবেচনাধীন, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। কানাঘুষা ছিল ৪ মার্চ তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন। কিন্তু তার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে আকস্মিক সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, তুরস্কসহ নয়টি দেশের কূটনীতিকরা। দুই মাস ধরে পুলিশ খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘেরাও করে রেখেছে। কূটনীতিকদের এই সাক্ষাতের ফলে সম্ভবত সরকার বুঝতে পেরেছে, ৬৯ বছর বয়সী একজন নারীকে অন্যায়ভাবে বন্দী করলে তা বেগম জিয়াকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তার বদলে সরকার খালেদা জিয়ার মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, বেগম জিয়া যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তাঁকে যাবজ্জীবন বন্দী রাখা যাবে।’
‘খালেদা জিয়াকে অনানুষ্ঠানিকভাবে আটক রাখার পর এখন তাঁর মাথার ওপর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ছড়ি ঘুরছে। খালেদা জিয়াই বিরোধী দলের একমাত্র প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব যাঁকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি।
গত কয়েক মাসে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে, গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে অথবা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে চাওয়া রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল বিএনপির ঘনিষ্ঠ নির্বাচনী মিত্র ও দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এর মধ্যে গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে রাজপথে নিহত হয়েছে ১২০ জনের বেশি মানুষ। এদের অধিকাংশই বিরোধীদের ছোড়া পেট্রলবোমায় নিহত হয়েছে এবং অনেকে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে।’
‘এমন পরিস্থিতিতে নিকট ভবিষ্যতে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন। খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা দৃশ্যত সংকটময় পরিস্থিতি উপভোগ করছেন। বিরোধী দলের উদারপন্থী সদস্যদের একঘরে করে রাখা হয়েছে। এর বদলে চরমপন্থী, বিশেষ করে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের জন্য স্থান ফাঁকা হয়েছে, যারা ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একটি নমুনা হলো গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রিকশা থেকে নামিয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যা। অভিজিৎ অনলাইনে ইসলাম ধর্মীয় চরমপন্থীদের সমালোচনা করেছিল। জবাবে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল তারা।’
এই অবস্থার কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান আছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। খালেদা জিয়ার একজন উপদেষ্টা মনে করছেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন একটি সমাধান হতে পারে। যদিও এ ক্ষেত্রে ২০০৭ সালের অভ্যুত্থানের সময় জাতিসংঘ তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা বলেছেন, বিএনপিকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরই মধ্যে, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছে। সড়ক অবরোধের ফলে পোশাক কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে পণ্যের অর্ডার কমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী নেতা ও ঢাকার অভিজাত শ্রেণী অসন্তুষ্ট। তাঁদের কেউ কেউ আরেক ধরনের পরিবর্তন আসন্ন বলে মনে করছেন। সেনাবাহিনী, বাংলাদেশের তৃতীয় রাজনৈতিক পক্ষ, যদি বেসামরিক রাজনীতিকদের আতঙ্ক সৃষ্টিকারী আচরণে বিরক্ত হয় এবং তাদের সবাইকে ছুড়ে ফেলে, তবে তা প্রথমবারের মতো হবে না।’
‘বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি সহযোগী যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সৌদি আরব এই ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের কঠোর বিরোধিতার কারণে শেখ হাসিনাকে নৈতিক সমর্থন জানাতে পারেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি যতটা সম্ভব স্থিতিশীল, উদার দেখতে চাইবেন। স্বাভাবিকভাবে ভারতের কোনো সফরকারী নেতা এমন সফরে অন্তত বিরোধী দলের প্রধান নেতার সাথে সাক্ষাৎ করার আশা করেন। সেটা এবার বেশ কৌশলীই হতে পারে।’