নোনাপানি সরিয়ে শোভনা বিলে বিপ্লব
‘১০ বছরের মধ্যে এমন ধান চোখে দেখিনি। এবার ধান দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। বিলে নোনাপানি নাই, সরকারি খালগুলো উন্মুক্ত হয়েছে। এটা না করলে হয়তো এবারও ধানের মুখ দেখতাম না।’
এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা গ্রামের ভৈরব চন্দ্র মণ্ডল (৫০)। তিনি বিলের ২৬ নম্বর পোল্ডারের গোপালপুর বিলে চার বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন। শুধু ভৈরব নন, একই গ্রামের কানাই লাল মল্লিক, শিবপুর গ্রামের আমজাদ শেখের চোখে-মুখেও হাসি।
ডুমুরিয়া সদর থেকে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়ক ধরে নতুন রাস্তার মোড় হয়ে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে দেখা মেলে শোভনা ইউনিয়নের। সেখান থেকে আরো এগুলে শাখাবাই নদী। একসময়ে এই নদী থেকে নোনাপানি তুলে সারা বছর আটকে রাখা হতো বলে এখানকার বিলগুলোতে ধান ও সবজি হতো না।
খাল ও জলাশয়গুলো প্রভাবশালীরা আটকে রেখে সেখানে চিংড়ি চাষ করত। বিলের পানি বের হতে পারত না। ফলে সেখানে কোনো ফসলও ফলত না বলে জানান শোভনা ইউনিয়নের কুলতলা গ্রামের রবিন মল্লিক।
শোভনা গ্রামের কানাই লাল মল্লিক (৫০) জানান, ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবদুল গনির চেষ্টায় বিলের অভ্যন্তরের খাল-নালাগুলোর সংস্কার করা হয়েছে। ভরাট হয়ে যাওয়া চারটি খাল খনন করা হয়েছে। পানি সরানোর প্রতিবন্ধক খালে দেওয়া নেট পাটাও তিনি অপসারণ করতে পেরেছেন। তাই অতি বৃষ্টিতেও এবার জলাবদ্ধতা দেখা দেয়নি।
শিবপুর গ্রামের বিশ্বজিত হালদার, বলাবুনিয়া গ্রামের অনিমেষ মণ্ডল আর শোভনা গ্রামের মনীন্দ্রনাথ মল্লিক জানালেন, দীর্ঘদিন এখানে কোনো ফসল ফলত না। কেউ বিলে লাঙল জোয়াল নিতে যেতে পারেননি। প্রভাবশালী চিংড়ি ঘের মালিকরা বিলে নোনাপানি প্রবেশ করিয়ে রাখত। তাদের কথা ছিল, ধান না হয়, না হোক চিংড়ির যেন ক্ষতি না হয়। তাই তারা বিলে নোনাপানি আটকে রাখত।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক চিত্তরঞ্জন চক্রবর্তী বললেন, ভদ্রা নদী ভরাট হয়েছে। ঘ্যাংরাইল নদীতে ২৬ নম্বর পোল্ডারের পানি নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত স্লুইসগেট নেই। আরো দুই-তিনটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে বিলের অভ্যন্তরের খালগুলো সংস্কার করা হলে বিলে আর জলাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
শোভনা গ্রামের সুভাষ বোস দুই বিঘা জমিতে শসা ও বেগুনের আবাদ করেছেন। তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা। তিনি বেগুন ও শসা বিক্রি করে প্রায় তিন লাখ টাকা পাবেন বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, মাত্র আড়াই থেকে তিন মাসে এই টাকা আয় করতে পারবেন।
শোভনা ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আলতাফ হোসেন জানান, এই ইউনিয়নে মোট আবাদযোগ্য জমি দুই হাজার ৭১০ হেক্টর। গত সাত-আট বছর আগেও এখানে সবজির আবাদ করা সম্ভব হতো না। বিল এলাকা ছিল নোনাপানি। আর নোনাপানিতে কৃষিজ পণ্য ভালো ফলন হয় না। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছর এই ইউনিয়নে কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে।
শোভনা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সরদার আবদুল গনি বললেন, ২৬ নম্বর পোল্ডারে গত ১০ বছর ফসল হতো না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিল এলাকায় নোনাপানি প্রবেশ করে চিংড়ি চাষ করত। এমনকি বিলের মধ্যে নেট পাটা দিয়ে রাখত। এতে বিলের পানি সহজে বের হতে পারত না। বৃষ্টির সময়ে জলাবদ্ধ থাকত। তাই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধ পাটা অপসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিলের অভ্যন্তরে নোনাপানি প্রবেশও বন্ধ করা হয়েছে।
ফলে এই পোল্ডারের ২০টি বিলে ৫০ হাজার একর জমিতে আমন মৌসুমে ধানের ব্যাপক ফলন হয়েছে। এ বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা শাখাবাই নদী, শিবপুর ও গোপালনগর খাল খনন করা হয়েছে। এতে অতিবৃষ্টিতেও বিলে পানি জমেনি, নিষ্কাশিত হতে পেরেছে।

মুহাম্মদ আবু তৈয়ব, খুলনা