আইএস লেখা ককটেল উদ্ধার, দুই মামলায় আটক ১
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে মঠের অধ্যক্ষকে হত্যার পর মঠ এলাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) লেখা ককটেল উদ্ধার করেছে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে খলিলুর রহমান (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ। তাঁর বাড়ি দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীডুবা গ্রামে। তিনি জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন বলে ধারণা করছে পুলিশ।
এদিকে এ ঘটনায় নিহত অধ্যক্ষের বড় ভাই রবীন্দ্র চন্দ্র রায় বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা তিনজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এছাড়া অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানায় পুলিশ।
আজ রোববার সকাল ৭টার দিকে উপজেলায় শ্রীশ্রী সন্তগৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে (৫০) গলা কেটে হত্যা করে অজ্ঞাতপরিচয়ের দুর্বৃত্তরা। এ সময় গুলি করা হয়েছে গোপাল চন্দ্র রায় (৩৫) নামে এক সাধুকে। ককটেল হামলায় আহত হয়েছেন মঠের পাশের এলাকার নিতাই পদ দাস (৪০)। দুর্বত্তরা মোটরসাইকেলে করে এসে এ হামলায় অংশ নেয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ময়নাতদন্তের পর অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়ের লাশ মঠ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। মঠের পাশে করতোয়া নদীর শ্মশানে বিকেল পৌনে ৫টায় তাঁর সৎকার করা হয়। সেখানে তাঁর স্বজন ও ভক্তরা উপস্থিত ছিলেন।
গুলিবিদ্ধ পুরোহিত গোপাল চন্দ্র রায়কে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ককটেলে আহত নিতাই ও ঘটনার কথা শুনে আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়া গোপালের মা চিরতা রানী (৬০) দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছেন।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, দেবীগঞ্জ উপজেলা সদরের করতোয়া নদীর পশ্চিম পাশে শ্রীশ্রী সন্তগৌড়ীয় মঠ। সকালে ওই মঠের পুরোহিতসহ তিন সাধু পূজা-অর্চনা করছিলেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালে যজ্ঞেশ্বর রায়সহ অন্যরা মঠ থেকে বেরিয়ে আসেন। দুর্বৃত্তরা আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায়।
মঠের বাইরে বাড়ির বারান্দায় যজ্ঞেশ্বরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা গেটে হত্যা করা হয়। এ সময় গোপাল চন্দ্র পালানোর চেষ্টা করলে তাঁকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। তাঁর পায়ে এবং হাতে গুলি লাগে। আরেক পুরোহিতের ওপর ককটেল হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় মঠের বাইরে কাজ করছিলেন নিতাই। তাঁর ওপরও ককটেল নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা।
মঠের পূজারি রাধামাধব দাসসহ ওই এলাকার কয়েকজন ব্যক্তি ঘটনার সময় দুজন যুবককে মঠ থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেন। তাঁদের দেখে দুর্বৃত্তরা আবারও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়।
পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. হুমায়ুন কবির, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টসহ (সিআইডি) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পুলিশ আলামত সংগ্রহ করে ঘটনাস্থলটি ঘিরে রেখেছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে দেবীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আইয়ুব আলীকে। তিনি জানান, ঘটনাস্থল থেকে কালো রঙের টেপ দিয়ে মোড়ানো এবং মার্কার কলম দিয়ে ইংরেজিতে আইএস লেখা রয়েছে এমন একটি অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে। এর সঙ্গে একটি রক্তমাখা জ্যাকেট, রক্তমাখা একটি চাপাতি, একটি পিস্তলের গুলি উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, ‘এটা জঙ্গিদের কাজ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। একজনকে আটক করা হয়েছে।’
এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ‘জেলার সব হিন্দু ধর্মশালায় নিরাপত্তা জোরদার ছিল। কারা হত্যাকারী এবং কী কারণে এ হামলা হলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত না করে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না।’
তবে এসপি জানান, প্রতিটি মন্দির-মসজিদে পুলিশ পাহারা ছিল। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির কারণে আজ কোনো পুলিশ ছিল না।
দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আখতার জানান, দুর্বৃত্তদের আটকের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় দেবীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলার পাশাপাশি অস্ত্র আইনেও মামলা হয়েছে।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন জানান, ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দোষীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’
পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, এর আগে শিয়া মসজিদসহ বিভিন্ন জায়গায় যারা হামলা চালিয়েছে, তারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
এদিকে অধ্যক্ষকে হত্যার প্রতিবাদে এলাকাবাসী দুপুরে দেবীগঞ্জ-পঞ্চগড় সড়ক অবরোধ করে। পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিচালক মো. হুমায়ূন কবীরের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ মিনিট পর অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে আগামীকাল সোমবার দেবীগঞ্জ উপজেলাবাসীর ব্যানারে বিজয় চত্বরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অধ্যক্ষের ভাই রবীন্দ্র রায় ও স্থানীয় সাধুরা জানান, অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার ইউনিয়নের সোনাহার গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে চলে আসেন দেবীগঞ্জ করতোয়া ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে সোনাপোতা এলাকায়। এখানে এসে তিনি ১৯৯৮ সালে মঠটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ মঠের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তিনি ব্রহ্মচারী (বিয়ে করেননি) ছিলেন। তিন ভাই ও দুই বোন তাঁর। তাঁরা সবাই গ্রামের বাড়ি সোনাহারে থাকেন। এই মঠে ধর্মসভা, ধর্ম নিয়ে আলোচনা আর পূজা-অর্চনা করা হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধুরা এখানে এসে আলোচনায় যোগ দেন। দু-একদিন থেকে তাঁরা আবার চলে যান।