স্ট্র্যাটফোরের বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের সামনে সহজ পথ খোলা নেই

বাংলাদেশে প্রায় তিন মাস ধরে চলা রাজনৈতিক সংকটে দেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। কিন্তু প্রধান দুই দল কোনো ধরনের সমঝোতায় আসতে রাজি হচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম মধ্যস্থতাকারী সেনাবাহিনীও কোনো ধরনের ভূমিকা নিতে চাচ্ছে না। এতে করে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
খুব শিগগির এর সমাপ্তি ঘটবে, এমন কিছুও দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এমন মূল্যায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি বৈশ্বিক গোয়েন্দা সংস্থা স্ট্র্যাটেজিক ফোরকাস্টিং (স্ট্র্যাটফোর)। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে স্থানীয় সময় ২০ মার্চ প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে এ মূল্যায়ন করা হয়।
স্ট্র্যাটফোর নিজেকে বলে ভূ-রাজনৈতিক গোয়েন্দা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৬ সাল থেকে নিয়মিত গোয়েন্দা ব্রিফিং প্রকাশ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
স্ট্র্যাটফোরের বাংলাদেশবিষয়ক বিশ্লেষণটিতে বলা হয়, ব্যাপক সহিংসতা ও অবরোধের তৃতীয় মাস হতে চলেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ চলতি বছরে বস্ত্রভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত খাতকে ইলেকট্রনিকস ও গাড়ির খাতে ধাবিত করেছে।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির সময় থেকে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির বড় তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন জোট।
রাজনৈতিক মধ্যস্থতা ও নতুন নির্বাচন আয়োজনে নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশের গভীর রাজনৈতিক বিভেদের ঐতিহাসিক মধ্যস্থতাকারী সেনাবাহিনীকে বিরোধীরা বারবার আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া মেলেনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে বড় ধরনের লড়াই শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন অস্থিরতায় জাতীয় অর্থনীতি ও বস্ত্রশিল্প প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে।
বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ এখনো ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থা, জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে মধ্য-ডানপন্থী ও ইসলামপন্থীদের গভীর বিভাজনজনিত সমস্যায় ভুগছে। এ কারণেই এ বছরের বেশির ভাগ সময়ে সহিংস অস্থিরতা পুরো দেশকে গ্রাস করেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যভুক্ত পশ্চিমা কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিক সহায়তার বিষয়টিকে পুঁজি করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমঝোতার জন্য চাপ দিতে থাকে। ওই দেশগুলো ১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের নিন্দা জানিয়ে বিরোধী দলের প্রতিবাদ কর্মসূচির ওপর আওয়ামী লীগের চড়াও হওয়ার নিন্দা জানিয়েছে।
পশ্চিমা এ দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমর্থন দরকার বাংলাদেশের। উপরন্তু বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র।
নির্বাচনকে ঘিরে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারভিত্তিক বাজার সুবিধা (জিএসপি) বাতিল করে। ইইউও একই হুমকি দেয়। এর ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করতে উদ্যোগী হয়।
তবে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সতর্ক সমঝোতার ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের স্থির হওয়ার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা দেশটির বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের জন্য সুবিধা বয়ে আনতে পারেনি।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসা আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম সমর্থক ছিল নয়াদিল্লি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ক্ষমতার পরিবর্তনে সহায়ক হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়। এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের একটি অঞ্চলে ঢাকার মালিকানা বর্ধিত হয়। ওই অঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল মজুদ থাকতে পারে, যা বিদ্যুতের সংকটে থাকা দেশটির জন্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সুফল বয়ে আনতে পারে। উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাও শুরু করেছে ঢাকা, যেখানে কম দামে শ্রম কেনা যায়। তাই বিভিন্ন কারখানায় নড়বড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা ও অনুন্নত পরিবেশ থাকার পরও চীন ও জাপানের মতো দেশগুলোর বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হয়েছে।
আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে পুঁজি করেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে খুবই কম ছাড় দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের পেছনে শক্তিশালী অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি থাকার পরও ইসলামপন্থী জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গড়া বিএনপির জোট নতুন নির্বাচনের দাবিতে এককাট্টা। একই সঙ্গে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও শেখ হাসিনার পদত্যাগ চায় তারা।
২০১৫ সালজুড়ে চলমান অচলাবস্থা অব্যাহত থাকবে।
অর্থনীতিতে অস্থিরতার প্রভাব
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি থেকে বাংলাদেশের মধ্য ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল ও এটির গতানুগতিক ইসলামী অংশীদার জামায়াতে ইসলামী সিরিজ হরতাল, অবরোধ ও সহিংস সংঘর্ষ শুরু করে। গত বছরের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসের পরিবর্তন হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সেনা হস্তক্ষেপের সুযোগ বন্ধসহ বেশকিছু সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার (যুদ্ধাপরাধের দায়ে) করে বিরোধী দলকে একঘরে ফেলেছে। বিএনপি ও এর রাজনৈতিক মিত্ররা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছে। এতে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে।
১৫ কোটির বেশি লোকের বাংলাদেশে লোকজন চলাচল ও পণ্য পরিবহনের জন্য সীমিত রেল, সড়ক ও ফেরি যোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল। বিক্ষোভকারীরা টায়ার জ্বালিয়ে ও বর্জ্যের স্তূপ করে সারা দেশে অবরোধ তৈরি করেছে। এতে লোকজনের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
অর্থনীতিতে এর (অবরোধের) প্রভাব সর্বত্রই দেখা যায়। মাঠে পচে যাচ্ছে শস্য, ক্রেতার অভাবে পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে শহরে থাকা শ্রমিকরা গ্রামে ফিরছে। কাজ পাচ্ছে না। বাড়ছে বেকারত্ব।
অভ্যন্তরীণ হিসাব থেকে জানা গেছে, গত তিন মাসে অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার।
শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া সমঝোতার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। ঐতিহ্যগতভাবে, বাংলাদেশের প্রায়শ গোলমেলে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনে মীমাংসাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সেনাবাহিনী। কিন্তু সামরিক নেতৃত্ব বর্তমান পরিস্থিতির সাথে নিজেকে জড়াতে চাইছে না। কারণ এতে অস্থিরতা ও সহিংসতা আরো বাড়তে পারে।
খালেদা জিয়ার বর্তমান কৌশল হলো (দাবি আদায়ে) শেখ হাসিনাকে বাধ্য করা অথবা সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে সেনাবাহিনীকে ঠেলে দেওয়া। কিন্তু সহিংসতা ও অস্থিরতা অবস্থা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় না বাড়লে আওয়ামী লীগ ও সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান পাল্টাবে বলে মনে হচ্ছে না।
তার ওপর, বাংলাদেশে অস্থিরতার চলমান পর্বে সেনাবাহিনী হয়তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কেউ (ডিসাইডিং ফ্যাক্টর) নয়ও।
গত কয়েক দশকে, বস্ত্র খাতের প্রধানদের প্রতিনিধিত্বকারী পেশাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশটিতে শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ৬০ শতাংশই এর সাথে যুক্ত এবং বার্ষিক রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে এ খাত থেকে।
ব্যবসায়িক নেতারা ৫ মার্চ বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে বিদেশি সরকার ও সংস্থা, অর্থনৈতিক অংশীদারদের মাধ্যমে সরকার এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার জন্য চাপ দেওয়ার উদ্যোগে সহায়তা করার অনুরোধ জানান। অর্থনৈতিক চাপ বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা ঠেকাতে পারবে না।
রাজনৈতিক মেরুকরণ, বিশেষ করে বিএনপির শিবির ও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে বিভাজন রয়ে যাবে, যেহেতু দুই পক্ষই রেষারেষির চরম সীমায় অবস্থান করছে।
শেখ হাসিনা তাঁর দুই বিরোধীপক্ষ বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক ও নেতাদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও আইনি পদক্ষেপের হুমকির মাধ্যমে নিঃশেষ করে ফেলতে চাইছেন।
অন্যদিকে বিএনপির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং পশ্চিমা মহলের কাছে একঘরে হয়ে যাওয়ার শঙ্কা নিয়েও আশা করছে, সরকার এই অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বারবার বিরোধী দলকে বলে যাচ্ছেন হরতাল-অবরোধ বন্ধ করতে। এমনকি তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
এখানেই কেবল আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে আছে। অন্তত তাদের নিজেদের চোখে।
ক্ষমতাসীন দলের প্রতিবেশী ভারতের সাথে রয়েছে একটি শক্তিশালী বন্ধন, ভালো সন্ত্রাসবিরোধী রেকর্ড এবং ঐতিহ্যগতভাবে শ্রমিক দলগুলোর সাথে ভালো যোগাযোগের কারণে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবে থেকেও এগিয়ে আছে।
বাংলাদেশ সরকারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, পোশাক রপ্তানি এখনো বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পোশাকশিল্পে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৭.৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে হয়েয়ে ৬ শতাংশ। যদিও এ শিল্পসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মতে, পোশাকশিল্পে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলার কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদি আদেশ ৫০ শতাংশ কমেছে। এর সুফল পাচ্ছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস। রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও গত দুই বছরে বাংলাদেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।
কোনো ধরনের অভ্যুত্থানের (ক্যু) বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে উঠতে পারে। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী সতর্ক। ক্রমবর্ধমান বিক্ষুব্ধ ইসলামপন্থী প্রবণতার দিকেও সতর্ক দৃষ্টি আছে বাহিনীর।
যেহেতু অর্থনীতি এখনো প্রবৃদ্ধিতে আছে এবং বিএনপির ডাকা অবরোধের প্রতি সমর্থন কমছে, সেহেতু বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ঠেকানোর যথাযথ উদ্দীপনা সেনাবাহিনীর নেই। বাহিনীর পক্ষে গত ৪০ বছরেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি।
সেনাবাহিনী বারবার ঘোষণা দিয়ে বলছে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে অস্থিরতা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে দ্রুত বা সহজ কোনো পথ খোলা নেই।