আগের চাইতে ভালো নির্বাচন হয়েছে : সিইসি
সব ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।
আজ শনিবার বিকেলে নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে ইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন সিইসি।
সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনে সহিংসতা এবং অনিয়ম প্রতিরোধে সমাজে সংস্কার আনতে হবে। এ জন্য সামাজিক দায়িত্বও আছে। আমরা সব ধাপেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি। তাই ষষ্ঠ ধাপের আগের রাতে সিল মারার ঘটনা একদমই ঘটেনি।’
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, সারা দেশে অন্যান্য সব কেন্দ্রে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে বলে টিভিতে দেখিয়েছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নির্বাচিত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ষষ্ঠ ধাপে নির্বাচনে একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, নারী ভোটারদের পাশাপাশি পুরুষ ভোটারদেরও দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।
দেশের চার হাজার ৫৫৫টি ইউপিতে জুনের মধ্যে চার হাজার ২৭৫টি ইউপি নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ছিল। সে লক্ষ্য নিয়ে ইউপি নির্বাচন শুরু করা হয়।
প্রধম ধাপে ৭৫২টি ইউপির নির্বাচনের জন্য ১১ ফেব্রুয়ারি তফসিল ঘোষণা হয়েছিল। দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত নির্বাচন সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয়েছে। টিভি মনিটরিংও করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যম হতে প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সিইসি বলেন, ষষ্ঠ ধাপে কয়েকটি জায়গায় সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় এ পর্যন্ত তিনজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি প্রিসাইডিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণের বহির্ভূত হওয়ায় ৩৬টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়েছে।
এবারের নির্বাচনের শুরু থেকেই কেন্দ্র দখল করে দুষ্কৃতকারীর ব্যালটে সিল মারা বন্ধ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কঠোর নির্দেশ ও কার্যকরী পদক্ষেপের কারণেই এই অপসংস্কৃতি সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। পঞ্চম ধাপের নির্বাচনের আগের রাতে একটি কেন্দ্রে সিল মারার ঘটনা ঘটলেও ষষ্ঠ ধাপে কোথাও এ ঘটনা ঘটেনি।
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, ইউপি নির্বাচনের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যাপক সংখ্যক ব্যালট পেপার মুদ্রণ ও যথাসময়ে তা নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছানো। এতো অল্প সময়ে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের জন্য প্রায় ২০ কোটি ব্যালট মুদ্রণ করতে হয়েছে। বিশেষ করে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক থাকায় স্বল্প সময়ে নির্ভুল ব্যালট মুদ্রণ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল। কর্মকর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেছে।
‘নির্বাচন কমিশনের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল শেষ মুহূর্তে আদালতের আদেশে নিষেধাজ্ঞা এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা। যে কারণে অনেক ব্যালট পেপার নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া রাস্তায় দুর্ঘটনা এবং পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণেও অনেক ব্যালট পেপার নষ্ট হয়েছে। যে কারণে পুনরায় মুদ্রণ করতে হয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, প্রত্যেক প্রার্থী যাতে প্রচারণার সমান সুযোগ পায় এবং প্রত্যেক ভোটার যাতে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন এবং কোথাও যাতে নির্বাচনী সহিংসতা না হয়, সে লক্ষ্য নিয়েই নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করেছে। কোথাও কোনো শিথিলতা বরদাশত করা হয়নি।
প্রথম পর্যায়ে তফসিল ঘোষণার পর পরই মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। এ ছাড়া তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের আগেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আরেকটি সভা করা হয়। কেন্দ্র দখল করতে আসা সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। শত শত নিরীহ ভোটার ও কর্মকর্তাদের জানমালের নিরাপত্তা এবং ভোটের উপকরণ রক্ষায় রাষ্ট্রীয় কাজে বাধাদানকারী এসব সন্ত্রাসীদের কঠোরভাবে দমন করাই ছিল কমিশনের নির্দেশ।
তাই, যখন যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে বলেন সিইসি। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা পুলিশ সুপার (এসপি) ও বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করেছি। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের (এমপি) বিরুদ্ধে মামলা এবং এলাকা ছাড়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। কাজেই সবচেয়ে ভালো দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা চেষ্টা করেছি।’
এ যাবৎ ইউপি নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেটরা আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে ৫০০ জনকে ১২ লাখ ৮৫ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা করেছেন। এ ছাড়া ১৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
১৯৮৮ সালে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি ছিল। এবার তাও ছাড়িয়ে গেছে। ইসি নিজেকে সফল মনে করে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘যে কোনো মানুষের প্রাণহানি একটা দুঃখজনক বিষয়। আমরা এসব ব্যাপারে মর্মাহত এবং গভীর শোক প্রকাশ করছি। আমরা চাই না, একটিও প্রাণহানি হোক। কিন্তু অন্যদিকে শত শত নিরীহ ভোটার এবং নির্বাচনী কর্মকর্তা, রাষ্ট্রীয় মালামাল সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করাও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে জন্য যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ততটুকু নিয়েছি নির্বাচন কমিশন।’
সিইসি আরো বলেন, ‘এ ছাড়া একে তো ইউপি নির্বাচন। ভেরি কমপিটিটিভ। সে জন্যই তিক্ততা একটু বেশি। আরেকটা বিষয় মনস্তাত্ত্বিক- আমাদের যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়ান, তাঁরা সকলেই মনে করেন নিজেরই জয়ী হওয়া উচিত। ভোটাররা কী ভাবে তা তোয়াক্কা করেন না কেউ। যে জন্য তাঁরা যে কোনোভাবেই হোক নির্বাচনে জিততে চান। এ সমস্ত কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। আমাদের কাজ নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে করা। আমরা চেষ্টা করেছি সুষ্ঠুভাবে করতে। গুটিকয়েক এলাকা ছাড়া সারা দেশেই কিন্তু সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে।’
সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় কী, যে কারণে ভালো নির্বাচন করা গেল না। এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আমরা মনে করি আগের চাইতে ভালো নির্বাচন করা গেছে। প্রথম পর্যায়ে যেভাবে শুরু হয়েছিল, তার চাইতে ইমপ্রুভ হয়েছে। ডেফিনেটলি ইমপ্রুভ হয়েছে। এ ধাপে নয়, সামগ্রিকভাবেই ইমপ্রুফ হয়েছে।’
প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, ‘নির্বাচনে সহিংসতার একটি বড় কারণ হচ্ছে অস্থিরতা। এটা সমাজের সর্বস্তরেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিশুকে সামান্য কারণে আছড়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। সেদিন দেখলাম, মোবাইল ফোন চুরি করার কারণে মেরে ফেলা হয়েছে। জীবনের দাম এখন সবচেয়ে কম হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। সবকিছুর দাম বাড়ে, জীবন ছাড়া। তাই সামাজিক পারসেপশনে পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের দায়িত্বও আছে। আশা করি, ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা ছাড়াই নির্বাচন করতে পারব।’
ইউপি নির্বাচন করে সন্তুষ্ট কি না? এ প্রশ্নের জবাবে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘এটা সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ব্যাপার না। এটা একটা দায়িত্ব পালন করে যাওয়া এবং দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করার চেষ্টা করা।’
এত মানুষের মৃত্যুর দায় কে নেবে? এ প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘এটা একটা সামাজিক ব্যাপার। সমাজেই এর সংস্কার আসতে হবে। আমাদের মানসিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসতে হবে। একটা বাচ্চাকে আছড়ে মেরে ফেলা নরমাল বিষয় নয়।’
সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ, মো. শাহ নেওয়াজ, ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান ও জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা