রাবি শিক্ষক হত্যা : অনিন্দ্য তিনদিনের রিমান্ডে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলায় একই বিভাগের ছাত্র মুনতাসিরুল আলম অনিন্দ্যর (২৬) তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আজ বুধবার দুপুরে রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-২ খালেদ হোসেন খান এ আদেশ দেন।
গত ২ জুন রাতে গোয়েন্দা পুলিশ অনিন্দ্যকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। তিনি রাজশাহী মহানগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ও রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি শফিউল আলম লাটকুর ছেলে এবং সাবেক সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের চাচাতো ভাই।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ইফতে খায়ের আলম জানান, রাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল হত্যা মামলায় একই বিভাগের অনিন্দ্যকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) গ্রেপ্তার করে। এরপর তাঁকে আদালতে পাঠিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির পুলিশ পরিদর্শক রেজাউস সাদিক।
গত ২৩ এপ্রিল সকালে মহানগরীর শালবাগান এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে বাসা থেকে ২০০ গজ দূরে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। তাঁর গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারার দরগামারিড়া গ্রামে। এ ঘটনায় ওই দিন নিহত শিক্ষকের ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ বাদী হয়ে বোয়ালিয়া মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলার বেশ অগ্রগতি রয়েছে। এ মামলায় বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
পুলিশের ওই সূত্র জানায়, অধ্যাপক রেজাউল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার অনিন্দ্যের বাবা শফিউল আলম লাটকু মহানগর বিএনপির সাবেক নেতা। লাটকু মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের বাবার চাচাতো ভাই। অনিন্দ্যের ছোট চাচা মাহফুজুল আলম লোটন মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, অনিন্দ্যের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত মিলেছে। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী এই পরিবারের সন্তানের জঙ্গি সম্পৃক্ততায় চরম ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে দলের সভাপতি লিটনের কারণে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে পারছেন না।
অনিন্দ্যর সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসএসসি ও এইচএসিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন অনিন্দ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তির পর প্রথমে ছাত্রদল করতেন। এরপর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়ান। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আহমদ-বিপু কমিটিতে হঠাৎ করেই অনিন্দ্য আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক পদ পেয়ে যান। তবে ধীরে ধীরে তাঁর চলাফেরা ও আচরণ বদলাতে থাকে। বাবরি চুল আর লম্বা দাড়ি দেখা যায় তাঁর। তবে সব সময়ই পরনে জিন্স ও শার্ট বা টি-শার্ট থাকত। তিনি সহপাঠীদের সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না। ক্লাসেও নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন না।
গত ২৩ এপ্রিল সকালে বাড়ির পাশেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
পুলিশের দাবি, এ হত্যায় জঙ্গিরা জড়িত। এ হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ একই বিভাগের বেশ কয়েকজন ছাত্রকে সন্দেহের তালিকায় রাখে। এর মধ্যে সন্দেহভাজন এক ছাত্রের নাম শরিফুল ইসলাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইংরেজি বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, শরিফুল ইসলাম অন্তত দেড় বছর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারের সঙ্গেও শরিফুলের কোনো যোগাযোগ নেই। শরিফুলও বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশতেন না। তারা ‘লর্ডস গ্যাং’ নামে একটি ফেসবুক পেজের (বর্তমানে পেজটি আর দেখা যায় না) সন্ধান দিয়ে জানান, এই পেজে মুনতাসিরুল আলম অনিন্দ্য ও শরিফুল ইসলামের গ্রুপ ছবি পাওয়া যায়। তাদের দুজনেরই নিবিড় সম্পর্ক ছিল।
মহানগর পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী অনিন্দ্য ও শরিফুল জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে। শরিফুল জঙ্গি সম্পৃক্ততায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে অনুমান করছে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার কয়েকদিন পরই অনিন্দ্য ও শরিফুলের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়। শরিফুল নিখোঁজ। আর অনিন্দ্য মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির নিকটাত্মীয় হওয়ায় তৎকালীন মহানগর পুলিশ কমিশনার এ বিষয়ে আর এগোননি। তবে নতুন কমিশনার যোগদানের পরই এ মামলাটি গতি পায়। ফলে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ও কিছু তথ্য থাকায় অনিন্দ্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) এ কে এম নাহিদুল ইসলাম জানান, অধ্যাপক রেজাউল হত্যায় জঙ্গিরা জড়িত, এটি এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে। আর অনিন্দ্য ও শরিফুলের নেতৃত্বে সাতজনের একটি জঙ্গি গ্রুপ সক্রিয় থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে। তারাই মূলত এ হত্যায় জড়িত বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। এই তথ্যের ভিত্তিতেই অনিন্দ্যকে ২ জুলাই নগরীর কাদিরগঞ্জের একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে অনিন্দ্যর ছোট চাচা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহফুজুল আলম লোটন বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করি। অথচ আমাদের পরিবার থেকেই জঙ্গি হয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু বলার নেই।’