বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন
খুলনার দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ইউনিয়নে রিপন মণ্ডলদের গ্রামের চারপাশে পাঁচটি নদী আছে৷ গত বছরের খরায় তার বাবার তরমুজের ফলন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ রিপন তার বাবার কষ্ট বুঝতে পারেন৷ ‘আমি বাবার মানসিক কষ্টটা বুঝতে পারি৷ তাকে আমাদের পড়ালেখার খরচ দিতে হয়৷ তিনি যে ঋণে ডুবে যাচ্ছেন, সেটা বুঝতে পারি’, থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন রিপন৷
রিপনের বাড়ি প্রত্যন্ত এলাকায়৷ ‘সবচেয়ে কাছের হাসপাতালে গিয়ে মানসিক চিকিৎসক দেখাতে অন্তত দুটি নদী পার হতে হয়৷ সময়ও অনেকক্ষণ লাগে’, বলেন তিনি৷
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হতে পারে বলে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিয়েছে৷
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সম্ভাব্য অবনতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যখাতের পেশাজীবীরা৷ তারা বলছেন, চরম আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাড়তে পারে৷ প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানীর সংখ্যা খুব কম হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের৷
২০১৯ সালে সরকারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজনের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা আছে৷ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাটি ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বাড়তি তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা মানুষের উদ্বেগ ও বিষণ্নতায় ভোগার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান বলেন, ‘প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা পেশাজীবীর সংখ্যা খুবই কম৷’
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে বলে মনে করে বাংলাদেশ সরকারও৷ তাই ২০২২ সালের জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনায় বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিশেষ করে নারী ও প্রতিবন্ধীদের ওপর৷
পরিস্থিতির উন্নয়নে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা পেশাজীবী, এনজিও ও বিভিন্ন স্টার্ট-আপ চেষ্টা করছে৷ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন এলাকার মানুষকে সহায়তা করতে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে৷ যেমন ‘মনের বন্ধু’ নামের একটি সংস্থা জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে মিলে খুলনার দাকোপ এলাকার বাসিন্দাদের মানসিক সহায়তা দিচ্ছে৷
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী তৌহিদা শিরোপা বলেন, ‘দুর্যোগ শুধু ভৌত অবকাঠামোরই ক্ষতি করে না, বিভিন্নভাবে মনেরও ক্ষতি করে৷’
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি৷ তাই ‘জলবায়ু উদ্বেগ’ ও ‘ইকো-শক’ নামে দুটি বিষয় বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে৷
এদিকে, মানসিক চিকিৎসা বিষয়টি বাংলাদেশে এখনও ট্যাবু হওয়ায় অনেক মানুষ, বিশেষ করে গ্রামবাসীরা এখনও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে চান না৷ পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের শিশু মনোবিদ দীপন চন্দ্র সরকার বলেন, ‘একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না গেলে মানুষ এখনও মানসিক চিকিৎসা নিতে চায় না৷’
দীপন চন্দ্র সরকার বলেন, ‘এখনও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায়, বিশেষ করে দুর্যোগপ্রবণ দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা পেশাজীবীর অভাব রয়েছে৷ এ কারণে সরকার ও এনজিওগুলো মাঝেমধ্যে সেসব এলাকায় সাইকো-থেরাপিস্ট পাঠিয়ে থাকেন৷ কিন্তু, এমন স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না।’ তাই বাংলাদেশের জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনায় টেলিহেলথ সেবার পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই মনোবিদ৷
‘মনের বন্ধু’ সংস্থা তৃণমূলের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যেন তারা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন এমন মানুষকে কোনো পরামর্শকের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে পারেন৷
এছাড়া বাগেরহাটে স্বাস্থ্য বিভাগের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেহেদী হাসান অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘জুম’ এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মী ও জরুরি সেবাকর্মীদের দুর্গত এলাকার মানুষকে কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে, সেই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন৷