পুকুরে মাচা বানিয়ে বসবাস করছেন মিনারা বেগম
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2023/09/26/jhalakathi-minara-1-pic-25-09-2023.jpg)
“আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।”
কবি জসীম উদদীনের আসমানী কবিতার আসমানী ভেন্না পাতার ছাউনির নিচে থেকেছেন বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু এই সময়ের আসমানী ঝলকাঠির মিনারা বেগম তিন মাস ধরে দশম শ্রেণি পড়ুয়া নাতিকে নিয়ে থাকেন পুকুরের মধ্যে বাঁশ দিয়ে মাচা বানিয়ে পলিথিনের ছাউনির নিচে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানহীন মিনারা বেগম আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। স্বামী কিংবা বাবার ভিটেমাটি না থাকায় মামাতো ভাইদের কাছে ছুটে যান একটু আশ্রয়ের জন্যে। সেখানেও ভিটেমাটিতে ঠাঁই দেয়নি মামাতো ভাইয়েরা। অগত্যা পানির উপরে এই শূন্যে তার বসবাস।
“আমার স্বামী মইর্যা গেছে ১৫ বছর হইছে। আমার একটা নাতি আছে। ও আমার লগে থাহে। এই নাতিরে লইয়া অনেক কষ্টে দিনযাপন করছি। আয় রোজগার না থাহায় অসহায় হইয়্যা পড়ছি। মোর মায়ের জায়গা পামু মামা বাড়ি। কিন্তু আমারে ঘর বানাইতে দেয়নায় বাড়িতে। তিনবছর ধইর্যা মামাতো ভাইগো কাছে ঘুরতে আছি। কোন উপায়ন্তর না পাইয়্যা পরে মানুষের দ্বারে হাত পাইত্যা কিছু টাকা উঠাইয়া বাঁশের খুঁটি আইন্যা পুহোইরের (পুকুর) মধ্যে মাচা বানাইয়া থাহি।
কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা শহরের সবুজবাগ এলাকার অসহায় বিধবা নারী মিনারা বেগম (৬০)। মিনারা বেগমের বিয়ে হয়েছিল ফরিদপুরে। তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার কারণে সেখানে যা জমিজমা ছিল তা বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছেন। তাঁর বাবার বাড়ি নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের রাজপাশা গ্রামে। সেখানে তাঁর কোন জমি নেই। তাই নানা বাড়িতে তাঁর মায়ের জমিতে ঘর উত্তোলন করে বসবাস করতে চেয়েছিলেন এই বৃদ্ধা নারী। কিন্তু মামাতো ভাইয়ের বাধার কারণে ঘর তুলতে পারছেন না বলেও অভিযোগ করেন মিনারা বেগম। পরে মায়ের জমিতে পুকুরের মধ্যে বাঁশের খুঁটি দিয়ে মাচা তৈরি করে পলিথিন দিয়ে তিনমাস ধরে বসবাস করছেন তিনি ও তাঁর নাতি নিরব সরদার (১৫)। নাতি নিরব নলছিটি সরকারি মার্চেন্টস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। পড়ালেখার খরচও বহন করতে হয় নানি মিনারা বেগমকে।
মিনারা বেগম জানান, তাঁর কোন ছেলে সন্তান নেই। একটি মেয়ে আছে, স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়েছে। মেয়ে বর্তমানে চট্টগ্রামে থাকে। তিনি নাতিকে নিয়ে তিনবছর ধরে নলছিটিতে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে ঘুরেও কোন সহযোগিতা পাননি। সরকারি ঘরের জন্য দুইবার আবেদন করলেও তাঁর কপালে জোটেনি। তাছাড়া বিধবা ভাতার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে গেলে, সেখান থেকে জানানো হয় কোটা খালি নেই।
মিনারা বেগম অভিযোগ করেন, থাকার কোন জায়গা না পাইয়্যা যখন মামাতো ভাইদের কাছে গ্যাছি, তাঁরা আমারে ধাক্কা মাইর্যা ফালাইয়া দিছে। বাঁশ খুঁটি ভাইঙ্গা ফালাইয়া দিয়া ঘর বানাইতে দেয়নায়। এরপর আমার মামাতো ভাই সিদ্দিকুর রহমান বলেন যদি জায়গা নেন, তাহলে মাটির ওপরে দিমু না, পুকুরের মধ্যে আছে সেখানে নেন। পরে আমি কি করমু আমার কপালে যা আছে, তাই করলাম। পুকুরের মধ্যে বাঁশের খুঁটি দিয়া মাচা বানাইয়া তিন মাস ধরে নাতিরে লইয়া থাহি।
নলছিটি পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মুনির বলেন, বিধবা ওই মহিলা তাঁর নাতিকে নিয়ে তিন মাস ধরে এখানে বাঁশের খুঁটির মাচা বানিয়ে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে পুকুরের ওপর থাকছেন। আসলে একটা মানুষ কতটা অসহায় হলে এভাবে বসবাস করছে তা বলে বুঝাতে পারব না। আমার কাছে এলে আমি ফেসবুক লাইভ করলে বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। ঢাকার জসিম ভাই নামে এক সাংবাদিক তাদের দুই বান টিন কিনে দিয়েছে। আসলে তাঁর দরকার থাকার মতো একটা ঘর।
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/09/26/jhalakathi-minara-2-pic-25-09-2023.jpg 687w)
এবিষয়ে মিনারা বেগমের মামাতো ভাইদের বাড়িতে না পাওয়ায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
নলছিটি উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বলেন, মিনারা বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে ওনি যদি ভাতা পাওয়ার প্রাপ্য হন, তাহলে অবশ্যই ভাতার আওতায় আনা হবে।
নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, মিনারা বেগমের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি ওখানে যাব। গিয়ে তাঁর অবস্থা দেখব। তাঁর জন্য সরকারি সহায়তা করা হবে।