ট্রেন দুর্ঘটনা নয় নাশকতা, তদন্তে তিন কমিটি
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা নয় নাশকতা, তদন্তে তিন কমিটি গঠন। অবরোধকারীরা নাশকতার জন্য ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইন কেটে ফেলায় ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে।
আজ বুধবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জেলার ভাওয়াল স্টেশনের কাছে বনখড়িয়া এলাকার চিলাই ব্রিজের পাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ঘটনা তদন্তে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্ঘটনা ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি রেললাইন থেকে ছিটকে নিচে পড়ে এবং রেললাইন দুমড়ে মুচড়ে যায়। এ ঘটনায় এক ব্যবসায়ী নিহত এবং চালক ও তার সহকারীসহ অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছেন।
নিহত ব্যবসায়ীর নাম মো. আসলাম (৩৫)। তিনি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা রৌহাসাইটা এলাকার মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। তিনি মুরগি ব্যবসায়ী।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানান, গতকাল মঙ্গলবার দিনগত রাতের কোনো এক সময় দুষ্কৃতকারীরা গ্যাস কাটার দিয়ে গাজীপুরের ভাওয়াল স্টেশন ও রাজেন্দ্রপুর স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকার চিলাই নদীর ওপর নির্মিত চিলাই ব্রিজের প্রায় ১০০ ফুট উত্তর পাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের পূর্ব পাশের প্রায় ২০ ফুট রেললাইন কেটে রাখে। এলাকাটি দুর্গম ও নির্জন। রাত ১১টায় মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি আজ ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ব্রিজে উঠার আগে সেখানে আসা মাত্রই বিকট শব্দে ইঞ্জিনসহ পরবর্তী সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ছিটকে রেললাইনের ঢালে কাত হয়ে পড়ে। তবে ইঞ্জিনটি বগি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাইনের পাশের জমিতে কাত হয়ে পড়ে। এ ঘটনায় এক ব্যবসায়ী নিহত এবং চালক (লোকোমাস্টার) ও তার সহকারী চালক এবং নারীসহ অন্তত ১২ জন যাত্রী আহত হন। বিকট শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে এসে ভিড় জমায়।
খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় হতাহতদের উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠায়। এ ঘটনায় রেললাইনের অন্তত ৬০০ ফুট দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রেল লাইনের পাশ থেকে একটি ও ঘটনাস্থলের পাশের জঙ্গল থেকে আরও একটি গ্যাসের সিলিন্ডার (বোতল) উদ্ধার করেছেন বলে দাবি করেছেন।
ঘন কুয়াশার কারণে ঘটনার সময় ট্রেনের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। এ ঘটনায় সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে একজন নিহত ও ১২/১৩ জন আহত হলেও ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে। গতি বেশি থাকলে হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
এদিকে সকাল ৯টার দিকে ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এ সময় শ্রীপুর থেকে একটি ইঞ্জিন এনে দুর্ঘটনা কবলিত বগিগুলো বাদে অবশিষ্ট বগিগুলো টেনে শ্রীপুর স্টেশনে নিয়ে যায়। দুর্ঘটনা কবলিত বগিগুলো উদ্ধার শেষে বিকেলে রেললাইন মেরামতের কাজ শুরু হয়।
রেল কর্মকর্তা মোশারেফ হোসেন ভুইয়া বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী ট্রেনগুলো ভৈরব-কিশোরগঞ্জ হয়ে চলছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বলাকা কমিউটার, দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার ও মহুয়া কমিউটার ট্রেনের যাত্রা কর্তৃপক্ষের আবেদনে বাতিল করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক মো. কামরুল আহসান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম ও গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী সফিকুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত ১৩ জনকে এ হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাঁরা হলেন ট্রেন চালক মো. ইমদাদুল হক (৫৭) ও সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া (৩২), ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রফিকুল মোল্লা (৩৫), একই উপজেলার জামিলা (৩৫), কুমিল্লার জসিম উদ্দিনের মেয়ে সুরভী সাহা (১৮), গৌতম সাহার স্ত্রী রুপালি সাহা (৪০), মনির উদ্দিনের ছেলে বেলাল উদ্দিন (৪০), জসিম উদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা (৪২), নিজাম উদ্দিনের ছেলে জলিল (৩৮), লালু মিয়ার ছেলে সুমন (২৫), কুদ্দুসের ছেলে সবুজ (৩২), ইসমাইল হোসেনের ছেলে এমদাদ (২৫), নেত্রকোনার গনু মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম মোল্লা (৪০)।
এদেরমধ্যে গুরুতর আহত ট্রেনচালক ইমদাদুল হক, সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া ও রুপালিকে সাহা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অপর আহত রফিকুল ইসলাম মোল্লা, জামিলা ও সুরভী সাহাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখান থেকে চলে গেছেন।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, শীতের রাত ও ঘন কুয়াশা থাকায় ট্রেনের গতি কম ছিল। তাই হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে। একজন যাত্রী নিহত হয়েছেন। আহত সাতজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। দুটি গ্যাস সিডিন্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। একটি সিলিন্ডার যে জায়গায় প্রায় ২০ ফুট রেললাইন কেটে রাখা হয়েছে তার পাশেই ছিল। অপর সিলিন্ডারটি কিছু দূরে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা দেখে বুঝাই যাচ্ছে, এটা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। দুষ্কৃতকারীরা গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে প্রায় ২০ ফুটের মতো লাইন কেটে রেখে দিয়েছিল। যার কারণে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। ইতিমধ্যে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘যারা অবরোধ দিয়েছেন তারা তো চান না রেল-বাস চলুক। ধারণ করা হচ্ছে যারা এটা চায় না, এটি তাদেরই উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ড।
ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক মো. কামরুল আহসান বলেন, প্রায় একশ স্লিপার এবং ৩০০ ফুট রেল লাইন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কোচগুলো রেললাইনের পাশে রাখব। পরে রেললাইন মেরামত করে ক্রমান্বয়ে কোচগুলো তুলে আনব। আমাদের ট্রেন চলাচল বন্ধ নেই। ঢাকা থেকে মংমনসিংহ- জামালপুর যেসব ট্রেন যায়, সেগুলো বিকল্প পথে ভৈরব হয়ে চলাচল করছে।
মো. কামরুল আহসান জানান, নিহত ব্যবসায়ীর পরিবারকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হবে। এ ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটি করা হয়েছে। ঘটনার ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটা নাশকতা।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী সফিকুল আলম বলেন, এটা দুর্ঘটনা নয়, নাশকতামূলক কাজ। যারা দুষ্কৃতকারী, যারা অবরোধকে সমর্থন দিচ্ছে- তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আমি মনে করি দুষ্কৃতকারীরা যে কাজটি করেছে, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। দেশের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। আমাদের টিম ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যেই এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব।
পুলিশ সুপার বলেন, পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরমধ্যে একটি রেল মন্ত্রণালয়, রেলওয়ে ঢাকা ডিভিশনের পক্ষ থেকে একটি এবং অপরটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সফিকুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি ঘটনাটি নাশকতা। তার পরও সঠিক কারণ অনুসন্ধানে বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সৌমিক শাওন কবিরকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটিসহ দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন বিভাগীয় পরিবহণ প্রকৌশলী, বিভাগীয় যাত্রী প্রকৌশলী, বিভাগীয় চিকিৎসক প্রমুখ।
জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসন থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করা হয়েছে। পাঁচ সদস্যের এ তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
অপরদিকে সন্ধ্যায় ঢাকা রেল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, দুর্ঘটনায় শুধু রেল লাইনের বগি-ইঞ্জিনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ইঞ্জিন-বগির পাশাপাশি ৬০০ ফুট রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১০০টি স্লিপার পুরোই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ৩০০ ফুট রেল লাইনে নতুন করে পাত বসানো হচ্ছে। যার ইতোমধ্যে ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমরা ধারণা করছি সন্ধ্যার মধ্যে পুরো রেললাইন মেরামত করে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে পারব।