কথিত ভোটাধিকারের দাবিতে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, অভিযুক্ত আবেদনকারী (মির্জা ফখরুল) দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করছেন, যাকে তিনি জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন দাবি করে আসছেন। দুর্ভাগ্যবশত, বিগত কয়েক মাসে দেখা গেছে যে, কথিত ওই ভোটাধিকারের দাবি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে যুক্ত হয়েছে। যাতে প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহণকারী সরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহন, পুলিশের গাড়িতে হামলার মতো ঘটনা রয়েছে।
সংক্ষেপে আরও বলা যায়, কথিত আন্দোলনকারীরাই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। আমরা এসব অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা বিবেচনায় নিয়েছি, যেগুলো দৃশ্যত দেশে আতঙ্ক তৈরি করেছে। বস্তুত দেশ ও দেশের জনগণকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সরকার বিরোধ আন্দোলনে গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ চলাকালীন বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
আজ মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১০ জানুয়ারি এ রায় দিয়েছিলেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়েছে, আমরা গুরুত্বের সঙ্গে উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক বিবেচনা করেছি এবং রেকর্ডটি পর্যবেক্ষণ করেছি। মামলার নথি থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বিচারিক আদালত সিডিটি দেখেছে এবং অভিযুক্ত আবেদনকারীর সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে এই মামলায়। তদুপরি, মামলাটি তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব সৃষ্টি না করে এখনও তদন্তাধীন থাকায় আমরা বলতে পারি যে, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা এবং ওই বাড়িতে জোরপূর্বক প্রবেশের অভিযোগগুলো সত্যিই অত্যন্ত গুরুতর। প্রধান বিচারপতি প্রজাতন্ত্রের তিনটি অঙ্গের একটির প্রধান। তাই প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে আমরা মনে করি।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, আসামিপক্ষের আইনজীবী দাবি করেন যে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান বিচারপতির বাসভবন থেকে অনেক দূরে ছিলেন। কিন্তু বরেন্দ্র কুমার ঘোষ এবং অন্যান্য মামলায় (প্রিভি কাউন্সিল, ২৩ অক্টোবর ১৯৪২) যা পোস্ট অফিস কেস নামে পরিচিত) সিদ্ধান্ত যে একজন ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দেওয়ার কারণে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারার অধীনে দায়বদ্ধ হতে পারে। এমনকি সেই প্ররোচনা দূরবর্তী স্থান থেকে হলেও। মেজর মো. বজলুল হুদা (আর্টিলারি) এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র মামলার ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছিল। আমরা মনে করি যে একজন ব্যক্তি তার অনুসারীদের অনেক দূর থেকে আদেশ দিতে পারেন।
প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, মামলার শুনানিতে মির্জা ফখরুলের আইনজীবীরা বলেছেন, আবেদনকারী অত্যন্ত অসুস্থ। এই দাবিটি এই দাবির বিরুদ্ধে যায় যে তিনি প্রধান অতিথি হিসাবে একটি বিশাল ভূমিকা পালন করেছিলেন যা একজন গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের অবশ্যই তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত না করে বলতে হবে যে তার জড়িত থাকার বিষয়ে কিছু অন্তর্নিহিত স্বীকারোক্তি রয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, অভিযুক্ত আবেদনকারী (মির্জা ফখরুল) দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করছেন, যাকে তিনি জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন দাবি করে আসছেন। দুর্ভাগ্যবশত, বিগত কয়েক মাসে দেখা গেছে যে কথিত ওই ভোটাধিকারের দাবি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে যুক্ত হয়েছে। যাতে প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহণকারী সরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহন, পুলিশের গাড়িতে হামলার মতো ঘটনা রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, কথিত আন্দোলনকারীরাই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। আমরা এসব অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা বিবেচনায় নিয়েছি, যেগুলো দৃশ্যত দেশে আতঙ্ক তৈরি করেছে। বস্তুত দেশ ও দেশের জনগণকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
রায়ে আদালত বলেন, আবেদনকারী বিপর্যয়কর ও উচ্ছৃঙ্খল এসব ঘটনার পরিকল্পনাকারী বা তার কোনো ভূমিকা ছিল কি না, সে বিষয়ে কেবল সুষ্ঠু তদন্তের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তদন্তের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে এই পর্যায়ে তার মুক্তির জন্য জামিন দেওয়া সহায়ক হবে না বলে আমরা মনে করছি। মামলায় কিছু ধারা আছে জামিন অযোগ্য। প্রজাতন্ত্র ও জনগণের নিরাপত্তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা রুলটি খারিজ করছি। তবে আবেদনকারী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোনো অসুস্থতায় ভুগলে তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমরা কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিচ্ছি।
এর আগে গত ১০ জানুয়ারি ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ চলাকালে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল খারিজ করে রায় দেন।
আদালতে মির্জা ফখরুলের জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। এসময় আদালতে মির্জা ফখরুলের পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল ও অ্যাডভোকেট সগির হোসেন লিওন, অ্যাডভোকেট মো. মাকসুদ উল্লাহ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বি এম রাফেল।
গত ৩ জানুয়ারি বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জামিন প্রশ্নে রুলের শুনানি পিছিয়ে ১০ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়।
ফখরুল-আব্বাস ছাড়াও মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, আব্দুল আওয়াল মিন্টু, আহমেদ খান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, ভিপি জয়নাল, মহানগর উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ফরহাদ হালিম ডোনার ও সদস্য সচিব আমিনুল হক।
তার আগে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জামিন প্রশ্নে রুলের শুনানির জন্য গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ৩ জানুয়ারি নির্ধারণ করেন হাইকোর্ট। সেদিন রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বি এম রাফেল।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় ৭ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কেন জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।