আজ ‘মিরপুর মুক্ত’ দিবস
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু ঢাকার মিরপুর তখনও পাকিস্তানপন্থিদের কব্জায়। সেখানে বিজয় আসে ’৭২ এর ৩১ জানুয়ারি। মিরপুর মুক্ত হতে দেরি হয়েছিল।
তখন একাত্তর শেষ হয়ে বাহাত্তর শুরু হয়ে গেছে। পুরো বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার থেকে মুক্ত। কিন্তু রাজধানীর বুকে মিরপুর তখনও অবরুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি অংশ সেখানে আত্মগোপন করেছিল। বিহারি ও রাজাকাররাও ছিল সক্রিয়। অবরুদ্ধ মিরপুর মুক্ত করতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেও ব্যর্থ হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থানার গেরিলা কমান্ডার (মামা গ্রুপ) ছিলেন শহীদুল হক মামা। মিরপুর মুক্ত করার কৌশল নির্ধারণের জন্য ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার শহীদ কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম ও শহীদুল হক মামার নেতৃত্বে একটি বৈঠক হয়। এ নিয়ে ‘মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি’ বইয়ে মিরাজ মিজু লিখেন, ‘‘বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিহারি কর্তৃক লুণ্ঠিত মালামাল বেচাকেনার বাজারটি (মিরপুর ৬ নম্বর সেকশন) গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর ২৯ জানুয়ারি শহীদুল হকের নেতৃত্বে ইপিআর জওয়ান, মামা গ্রুপের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, বাবর গ্রুপ, তৈয়বুর গ্রুপ, হানিফ গ্রুপ ও বিএলএফের মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু আত্মগোপনকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর বিহারি ও রাজাকারদের হাতে থাকা প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ও ভারী অস্ত্রের কাছে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিনের যুদ্ধে শহীদ হন তৈয়বুর গ্রুপের রফিকসহ নাম না জানা আরও কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা।”
৩০ জানুয়ারি সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের যৌথ অভিযান চলতে থাকে। সেদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪১ জন সদস্য এবং অনেক পুলিশ সদস্য শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম লেফট্যানেন্ট সেলিম। তবে টানা অভিযানে একসময় পর্যুদস্ত হয় আত্মগোপনে থাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও উর্দুভাষীরা। ৩১ জানুয়ারি মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের মাঠে (বর্তমান ঈদগাহ মাঠ) আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ের পরও দেড় মাস লেগেছে মিরপুর মুক্ত হতে। এর কারণ জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় বাহিনী ছিল মিরপুরে। তাদের জেনেভা কনভেনশন ও ভিয়েনা কনভেনশন মেনে কাজ করতে হচ্ছিলে। আন্তর্জাতিক কনভেশন অনুযায়ী কোনো অসামরিক ও নিরস্ত্র এলাকায় তারা অভিযান চালাতে পারে না। তবে তারা মাইকিং করে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল। পরে বাংলাদেশের বাহিনী দায়িত্ব গ্রহণের পর অভিযান পরিচালনা করে। তারাও আগে মাইকিং করে বলছিল, হানাদাররা যাতে আত্মসমর্পণ করে। পরে অভিযান চালানো হয়। সে সময় আবার পাকিস্তানি, রাজাকার ও উর্দুভাষীরা যে পাল্টা আক্রমণ করবে, সেটা ভাবতে পারেনি বাংলাদেশের বাহিনীর কেউ।’ এ কারণে সেই অভিযানে জহির রায়হানসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন বলে জানান লেখক ও নির্মাতা শাহরিয়ার কবির।
জহির রায়হানের শহীদ হওয়ার দিন
বড় ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারকে মিরপুরে কোনো একটি বাড়িতে আটক রাখা হয়েছে, এমন খবর পেয়ে তাকে খুঁজতে যান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক জহির রায়হান। সেটা ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির ঘটনা। বড় ভাইকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান জহির রায়হান। এ নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘পরিবারের সদস্যরা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে প্রতিমুহূর্ত অপেক্ষা করে আছেন জহির রায়হান কখন বাসায় ফিরবেন?’
এরপর থেকে ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান অন্তর্ধান দিবস পালন করা হচ্ছিল। তবে সাংবাদিক ও গবেষক জুলফিকার আলি মানিকের ‘মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুর/জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যভেদ’ বই থেকে জানা গেছে, মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের পানির ট্যাংক এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর বিহারি-রাজাকারদের সংঘবদ্ধ সশস্ত্র হামলার শিকার হন জহির রায়হান।
বইটিতে মিরপুর রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা নায়েক (অব.) আমির হোসেনের ভাষ্যে বলা হয়, বেলা ১১টায় সশস্ত্র হামলা করে বিহারি-রাজাকার-পাকিস্তানি বাহিনী। পানির ট্যাংকের পাশে লুটিয়ে পড়েছিল জহির রায়হানের দেহ। তার জামাজুড়ে ছিল রক্তের দাগ। জুলফিকার আলি মানিকের অনুসন্ধানের মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে জানা যায়, জহির রায়হান আসলে শহীদ হয়েছিলেন।
বড় ভাইয়ের খোঁজে জহির রায়হানের মিরপুরে যাওয়ার সময় একটা সময় পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন তার অনুজ চাচাতো ভাই লেখক ও নির্মাতা শাহরিয়ার কবির। জহির রায়হানের শহীদ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে প্রায় ২৭ বছর লাগার কারণ জানতে চাইলে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মিরপুরে নুরী মসজিদে বধ্যভূমি পাওয়া গেল ১৯৯৯ সালে। সেই সূত্র ধরেই জহির রায়হানের শহীদ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। তার আগে আমরা পরিবার থেকে তাকে নিখোঁজ বলে আসছিলাম। কারণ, আমরা তো মরদেহ দেখিনি। (মরদেহ দেখার আগে) আমরা কীভাবে বলব যে, তিনি শহীদ হয়েছিলেন।’
১৯৯৯ সালে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে জহির রায়হানকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও দেওয়া হয় বলেও জানান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
৫২ বছর পর সেই মিরপুর ও মিরপুরের উর্দুভাষীরা
স্বাধীনতার আগে মিরপুরে সংখ্যায় বেশি থাকলেও পরে সেখানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয় উর্দুভাষীরা। তাদের পূর্বসুরীরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতের বিহার থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। একসময় তারা মোহাজির বা বিহারি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। একাত্তরে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানে ছিল। ফলে ডিসেম্বরের পর বিহারিদের বড় একটি অংশ শরণার্থী হিসেবে পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। যারা যেতে পারেনি, তারা ‘আটকেপড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে ক্যাম্পের জীবন বেছে নেয়। এই জনগোষ্ঠীর দাবির মুখে বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন সময় তাদের পাকিস্তান পাঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানকার সরকার এতে সাড়া দেয়নি।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের তিন দশক পরে এসে ক্যাম্পের উর্দুভাষীরা পাকিস্তানে যাওয়ার ভাবনা থেকে সরে আসে। তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার দাবিতে সোচ্চার হন। এমনকি এ বিষয়ে আইনেরও আশ্রয় নেন। উর্দুভাষীদের নেতা সাদাকাত খান ফাক্কুর রিট আবেদনে সাড়া দিয়ে ২০০৮ সালের ১৮ মে উচ্চ আদালত তাদের ভোটাধিকার দেয়।
এরপর থেকে উর্দুভাষী সংগঠনগুলো প্রত্যাবাসনের বদলে পুনর্বাসনের দাবি আদায়ের জন্য কাজ করছে। এ বিষয়ে মিরপুরের উর্দুভাষী তরুণ সৈয়দ হাসান সোহেল বলেন, ‘আমরা জন্মগতভাবে বাংলাদেশি। এখানেই বড় হয়েছি। পাকিস্তানে গিয়ে কী করব? আমরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছি। তবু মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। ক্যাম্পের ১০/১২ ফুটের রুমের মধ্যে চার-পাঁচজন বসবাস করে। আধুনিক যুগে এসে এই মানবেতর পরিস্থিতি থেকে আমরা মুক্তি চাই।’
উর্দু স্পিকিং পিপলস ইউথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্টের (ইউএসপিওয়াইআরএম) তথ্যমতে, মিরপুরে বিহারি ক্যাম্পের সংখ্যা ৩৯। সেখানে প্রায় এক লাখ উর্দুভাষী বাস করছে। এসব ক্যাম্পের জায়গায় তাদের বৈধ কোনো অধিকার নেই। তাই ক্যাম্পবাসী সব সময় উচ্ছেদ আতঙ্কের মধ্যে থাকেন দাবি করে উর্দুভাষী যুব-ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ইমরান খান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর আমরা যখন নিজের ঘর-বাড়ি হারিয়ে ফেলি, তখন ক্যাম্পে রাখা হয়। পরে আবার এগুলো সরকার প্লট আকারে বরাদ্দ করে। তাই যারা মালিক, তারা ক্যাম্প উচ্ছেদের চক্রান্ত করে।’
ইমরান খান আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন আমরা একটা পরিচয়হীনতার মধ্যে ছিলাম। তারপর আমরা বাংলাদেশে ভোটাধিকার পেয়েছি। এখন তাই পাকিস্তান নিয়ে কেউ ভাবেও না। আমার বাবা, আমার দাদা কেউ পাকিস্তান দেখেনি। তাই আমরা পাকিস্তানে যাব কেন? বাংলাদেশেই স্থায়ী বাসস্থান চাই আমরা।’