‘পানি বিষয়ক সমস্যার সমাধান না হলে দেশ মহাবিপর্যয়ে পড়বে’
পরিবেশবাদি সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের (বানিপা) নেতারা বলেছেন, পানি বিষয়ক সমস্যার সমাধান না হলে দেশ মহাবিপর্যয়ে পড়বে। তারা বলেছেন, পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সঠিক ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বিশ্বের ২৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পায় না।
পানি বিষয়ে সচেতনতা ও গুরুত্বকে তুলে ধরতে প্রতি বছর ২২ মার্চ ‘বিশ্ব পানি দিবস’ পালন হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এ বছরও ‘বিশ্ব পানি দিবস’ পালিত হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ওয়াটার ফর পিস’, যা বাংলায় ‘শান্তির জন্য পানি’ নির্ধারণ করা হয়। এদিন বিকেলে পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন (বানিপা) ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে ‘শান্তি, প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় পানি : প্রেক্ষিত বাংলাদে’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ সুমন এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বানিপার সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন পবার কার্যকরী সভাপতি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ও বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের সভাপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও নাসফের সাধারণ সম্পাদক ও পবা’র সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী। এ ছাড়া ছায়াতল বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠাতা সোহেল রানা, পরিবেশ কর্মি সৈয়দা অনন্যা রহমান, আবু মোকারাম সর্দার, গাইনোকোলজিস্ট প্রফেসর ডা. বিলকিছ বেগম চৌধুরী আলোচনা সভায় তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
পবার সাধারণ সম্পাদক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ সুমন এক সংবাদি বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানান। তিনি আরওও জানান, আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বানিপার সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। মুল প্রবন্ধ পাঠে তিনি বলেন, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা এবং খাবার পানি সরবরাহ, নৌ চলাচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এম এ ওয়াহেদ আরও বলেন, মানুষের অত্যাচারে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। দখল, ভরাট, আর বর্জ্যে নদীগুলো এখন নিস্তব্ধ স্রোতহীন এবং দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য এবং জীববৈচিত্র শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীবন-জীবিকা আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। দেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিরই একই দশা। তিস্তার পানি প্রবাহ ব্যাপকহারে কমে গেছে। পদ্মা, তিস্তা এখন মৃতপ্রায়, যুমনায় পড়েছে চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা দখল, ভরাট ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। তিনি আরও বলেন, নদীতে পানি কমে যাওয়া বা না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়া এবং নদী হারিয়ে যাওয়ার কারণে ভূ-উপরস্থ কিংবা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি ঘাটতির অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। শুষ্ক মৌসুমে কৃষি কাজে ভুউপরিস্থ পানি মাধ্যমে পরিচালিত সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে।
এম এ ওয়াহেদ বলেন, অতিমাএায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, বাড়ছে ঝুঁকি। কোন কোন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। ভুগর্ভে কৃএিম রিচার্জ এবং কৃষি কাজে পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া প্রতিরোধ করা প্রয়োজন।
ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর দুই মিটার করে নেমে যাচ্ছে উল্লেখ করে এম এ ওয়াহেদ বলেস, ‘১৯৭০ সালে ঢাকা শহরে ৬ মিটার মাটির নিচেই পানি পাওয়া যেত। ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটারে, যা ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার, ২০১০ সালে ৬০ মিটার এবং ২০২৪ সালে এসে ৭৫ মিটারে নেমেছে।’
এরপর ভূপৃষ্টের পানি ব্যবহার ব্যবহারের বিষয়টি নগর পরিকল্পনা, বসতবাড়ী পরিকল্পনা বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করা। ঢাকা ওয়াসা সহ সকল নগরীতে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নদী বা জলাশয়ের পানি ব্যবহারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে স্বল্প মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী মাস্টার প্লান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ ১৪ সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে আছে—শিল্প-কারখানার পানির অপচয় রোধে পানির পুনর্ব্যবহারের নিমিত্ত ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপনের মাধ্যমে পয়ঃপ্রণালি ও ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত পানি পরিশোধন করা। বৃষ্টির পানি সোককুপ এর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থায় আবাসিক অথবা অনাবাসিক এলাকায় সেফটিক ট্যাংক ও সোককুপ স্থাপনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। জলাধার রক্ষায় পানি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা ইত্যাদি।