ফের ঢাকায় আসছেন ডোনাল্ড লু, গুরুত্ব পাবে যেসব বিষয়
মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আগামী মঙ্গলবার (১৪ মে) ঢাকায় আসছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি গত বছর ঢাকায় এসেছিলেন। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন নিয়ে শর্তহীন সংলাপের চিঠি দিয়েছিলেন। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তার এই ঢাকা সফর নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
ডোনাল্ড লু গত বছরের ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি ঢাকা সফর করেন। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে নানাভাবে তৎপর ছিল। এরপর এ বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে শর্তহীন সংলাপের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যারা বাধা দেবে, তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিল গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর। আর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুলিশ ও র্যাবের ১০ কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি।
ডোনাল্ড লু ১০ থেকে ১৫ মে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ সফর করছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে এই সফর নিয়ে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড লুর ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ সফর এই দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা জোরদার করবে। লুর সফরে অবাধ, উন্মুক্ত ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ থাকবে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জোরদারে ডোনাল্ড লু চেন্নাইয়ে মার্কিন কনস্যুলেট কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর তিনি কলম্বোতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারি জোরদারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ওই বৈঠকে তিনি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করবেন। উন্মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজের কেন্দ্র হিসেবে সক্রিয় নাগরিক সমাজের প্রতিও তিনি সমর্থন জানাবেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ডোনাল্ড লু তার ঢাকা সফরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সহযোগিতার বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের নেতা ও অন্যান্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরে এসে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষীয় বৈঠক করবেন। এর পাশাপাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তার সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে। দুই দিনের ঢাকা সফরকালে ডোনাল্ড লু নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় করার কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ওদের প্রচুর মেকানিজম আছে, ডায়লগ আছে। সেগুলো কীভাবে রিয়েক্টিভ করা যায়। ওদেরও আবার নির্বাচন আছে। কোন কোন মেকানিজমকে আরও এগিয়ে নেওয়া যাবে, এ বিষয়ে আলোচনা হবে। তার মধ্যে অবশ্যই রোহিঙ্গা ইস্যুটা আলোচনায় থাকবে। এ ছাড়া পারস্পরিক সম্পর্কের সব উপাদান থাকবে।’
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা যা বললেন
বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রেও স্টেট ডিপার্টপেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ ও গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য তাদের আকাঙ্খাকে সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতেছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিরোধী দলের হাজার হাজার সদস্যের গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনের দিন নানান অনিয়মের প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে অভিন্ন মতামত পোষণ করে, এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না এবং আমরা দুঃখিত, কারণ সব দল এতে অংশগ্রহণ করেনি।’
বিএনপির বিদেশবিষয়ক কমিটির সদস্য ড. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘গত বছর নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড লু যখন ঢাকা সফর করেন বিএনপির সঙ্গে তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক হয়নি। এবারও তিনি আমাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করবেন বলে আমার জানা নেই। তবে আমাদের সঙ্গে তো তাদের যোগাযোগ আছে। আমরা আমাদের অবস্থান জানাচ্ছি। এখানে তিনি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমরা আমাদের কথা জানাব। দেশ একটা ভয়ার্ত পরিবেশের মধ্যে আছে। এখানে নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার সব কিছুরই লঙ্ঘন হচ্ছে। এই তথ্য তাদের কাছেও আছে বলে আমরা মনে করি।’
আর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন এমপি বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনের আগে বিদেশিদের কাছে গিয়েছে, বিভিন্ন দূতাবাসের কাছে ধরনা দিয়েছে, তাতে কোনো কাজ হয়নি। এখনও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো কাজ হবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আগেও ভালো ছিল, এখনো ভালো আছে।’
বিশ্লেষকেরা যা বললেন
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মো. শহীদুল হক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। তারা রাখাইন এস্টেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশকে হয়তো তারা এই প্রক্রিয়ায় আরও বেশি যুক্ত করতে চাইবে। ডোনাল্ড লুর সফরের গুরুত্ব সেই দিকেই বলে আমরা মনে হয়। এখন তারা ভূ-রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।’
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তাদের যে কমন স্ট্যান্ড গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার সেই বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণভাবে কথা বলবে। তবে এর আগে হওয়া বেশকিছু আলোচনার ফলোআপও তারা জানতে চাইবে। কয়েক মাস আগে বড় একটা ডেলিগেশন এসেছিল। তার ফলোআপ হতে পারে।’
এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তো জানা। নির্বাচনের পর তো স্টেট ডিপার্টমেন্ট বিবৃতি দিয়ে অবস্থান জানিয়েছে। সেখানে তারা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছে।’
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, ‘তাদের এখন হয়তো মনোযোগ অর্থনৈতিক দিকে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনীতি নিয়ে তারা বলেই যাবে।’
আর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বিএনপির নয়া পল্টনের সমাবেশ ঘিরে সহিংস ঘটনার আগ পর্যন্ত তো যুক্তরাষ্ট্র উচ্চকণ্ঠ ছিল। তারপর থেকে তাদের ভয়েস ডাউন হয়ে যায়। এখন তারা অন্য কোনো পদ্ধতিতে এগোচ্ছে কি না আমি জানি না। তবে আমি মনে করি না, তারা কিল খেয়ে কিল হজম করে ফেলবে।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ডোনাল্ড লুর সঙ্গে তো দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হবে। রাজনীতি তো দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্যেই আছে। রাজনীতি নিয়ে কী আলোচনা হলো তখন তা জানা যাবে। যা প্রকাশ করা হবে তাতো জানা যাবেই। যা প্রকাশ করা হবে না তা-ও জানা যাবে।’
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে ডোনাল্ড লুর এবারের ঢাকা সফরটি হতে যাচ্ছে উচ্চপর্যায়ের প্রথম সফর। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লুবাখারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছিল। এইলিন লুবাখার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও বিশেষ সহকারী।