সরকারি জমিতে দুই বিধবার ঘর গুঁড়িয়ে দিল ভূমিদস্যুরা
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার দ্বীপাড়া গ্রামে সরকারি বন্দোবস্তের জমিতে তোলা দুই বিধবার ঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভূমিদস্যুরা। গতকাল রোববার (৩০ জুন) গভীর রাতে ও গত মঙ্গলবার এই দুই বিধবার ঘর গুঁড়িয়ে দেয় তারা।
গতকাল রাতে দ্বীপাড়া গ্রামের বিধবা নারী সুফিয়া বেগমের (৭৫) কাঠ ও টিন দিয়ে নির্মিত ঘরটি গুঁড়িয়ে দেয় ভূমিদস্যুরা। এ সময় তাঁর ঘর থেকে ৬০ হাজার টাকা এবং যাকাতের ১০টি কাপড়সহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট করে নিয়ে গেছে তারা। এর আগে গত মঙ্গলবার অপর বিধবা নুরজাহানের (৬০) ঘরটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দ্বীপাড়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের বিস্তীর্ণ সরকারি জমি। এই জমি সরকার ২০০১ সালে কতিপয় ভূমিহীন পরিবারকে বন্দোবস্ত দেয়। তখন থেকে কমপক্ষে ২০-২৫টি পরিবার সেখানে বসবাস করে আসছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে বন্দোবস্ত পাওয়া জমিতে দুটি পাশাপাশি ঘর তুলে বসবাস করছিলেন সুফিয়া বেগম ও নুরজাহান। সম্প্রতি মিজান নামের এক ব্যক্তি ওই জমি তাঁর বলে দাবি করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সরকারি সম্পত্তি নিজে বন্দোবস্ত নিয়েছেন দাবি করে মিজান ওই দুই বিধবার সম্পত্তি স্থানীয় প্রভাবশালী সিরাজ খাঁর কাছে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। সিরাজ খাঁ সেই জমি উজ্জ্বলের কাছে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। এরপর উজ্জ্বল ও সিরাজ খাঁ মিলে সন্ত্রাসী নিয়ে ওই দুই বিধবার ঘর দুটি গুঁড়িয়ে দেন।
এ ব্যাপারে বিধবা সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী নেই। ছেলেরাও খোঁজখবর নেয় না। সরকার আমারে একটু জমি দিছে। ওই জমিতে ২৩ বছর ধরে ঘরে তুলে থাকি। ঘরের মধ্যে পানি পড়ে। তাই গতকাল বৃষ্টির মধ্যে আমি ওই ঘরে থাকতে না পেরে আমার এক আত্মীয়র বাড়িতে চলে যাই। পরে সকালে এসে দেখি আমার ঘর নেই। আমার ঘর সিরাজ ও উজ্জ্বল মিলে ভেঙে দিয়ে গেছে। আমার ঘরে ৬০ হাজার টাকা ছিল, যাকাতের বেশ কিছু কাপড়ও ছিল। ওগুলোও নিয়ে গেছে তারা।’
অপর ভুক্তভোগী নুরজাহান বলেন, সরকার আমারে ২৩ বছর আগে জমি দিছে। আমি ঘর তুলে থাকছি। গত মঙ্গলবার উজ্জ্বল সন্ত্রাসী নিয়ে এসে দিনের বেলা আমার ঘরটা ভাইঙ্গা নিজেরা একটা ঘর তুইলা রাইখা গেছে। আমার ঘরের টিনগুলো খুইলা ফালাইয়া দিছে। আমি বাধা দিছি, আমারে মারতে ধরতে আসে। ওরা গায়ের জোরে আমাগো ঘর ভাইঙ্গা দিল। পরে আমি লোকজন নিয়ে প্রশাসনের কাছে যাই। এরপর যেসব লোকজন নিয়ে যাই তাদের হুমকি দেয়। আমরা গরিব মানুষ, এখন কোথায় যামু।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় আল আমিন বেপারী বলেন, ‘সিরাজ খাঁ একটা দালাল। সে সরকারি জমি মিজান খানের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে কিনে উজ্জ্বলের কাছে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করছে। পরে সিরাজ ও উজ্জ্বল মিলে সন্ত্রাসী নিয়ে এসে এই ঘরগুলো ভেঙে দিয়ে গেছে।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় মো. মতিউর রহমান বলেন, ‘২০ বছর আগে সরকার এই দুই বিধবা নারীকে জমিটুকু দিছিল। এখন সিরাজ খাঁ ও উজ্জ্বল সন্ত্রাসী লইয়া আইসা তাঁদের ঘর ভেঙে দিল। এই বিধবা দুই নারী এখন কই যাবেন?’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মনির হোসেন শেখ বলেন, ‘আমার এই এলাকায় অনেক ভূমিহীন পরিবারকে সরকার জমি বন্দোবস্ত দিছে। পাশাপাশি এই যে সুফিয়া ও নুরজাহান, এদেরও জমি দিছে। এখন সিরাজ খাঁ ও উজ্জ্বল তাঁদের ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা দিয়া ওই জমি জোর কইরা দখলে নিতাছে। এই বিধবাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত উজ্জ্বল বলেন, সরকার ওই জায়গাটি মিজান নামে এক লোকেরে বন্দোবস্ত দিছিল। হাশেম নামের এক লোক আমার কাছে ওই জমি বিক্রি করব বলছিল। আমি কিনতে রাজি হইছিলাম। কিন্তু আমি পরে কিনি নাই। কারা ওই জায়গার ঘর ভাঙছে আমি বলতে পারি না।’
‘এটা তো সরকারি জায়গা। কীভাবে বেচব’ জানতে চাইলে উজ্জ্বল বলেন, ‘সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমার কাছে বিক্রি করতে চাইছিল।’
এ ব্যাপারে অপর অভিযুক্ত সিরাজ খাঁ বলেন, ‘ওই জমিটা মিজানের। মিজান দখল করতে গেছে। আমি দখল করি নাই।’ ওই জমি মিজানের কাছ থেকে কিনে উজ্জ্বলের কাছে বিক্রি করার বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি।
এ ব্যাপারে টঙ্গীবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসলাম হোসেন বলেন, ‘সরকারি বন্দোবস্ত জায়গা কখনও হস্তান্তরযোগ্য নয়। অভিযোগটি স্থানীয় মেম্বার ফোনে আমাকে জানিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে এসিল্যান্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি যাদের ভেঙেছে তারা বিধবা নারী—এ ব্যাপারে আমরা বিশেষ দৃষ্টি দিব।’
টঙ্গীবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোল্লা সোয়েব আলী বলেন, ‘ঘর ভাঙার কথা উল্লেখ করে দুই নারী থানায় অভিযোগ করেছেন। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’