রাবিতে মৌনমিছিল : পুলিশের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ধ্বস্তাধ্বস্তি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) শিক্ষক ও কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) ক্যাম্পাসের বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের সামনে মৌন মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে শিক্ষার্থীদের আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের কাছ থেকে তিন শিক্ষার্থীকে তাৎক্ষণিক ছিনিয়ে নিয়েছে উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এ সময় এক সাংবাদিককে মারধর ও অপর এক সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আজ বেলা সোয়া ১১টার দিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের সামনে থেকে মৌন মিছিল বের করে। ‘ছাত্র-জনতার খুনিদের প্রতিহত করুন’ শিরোনামে মিছিলে শিক্ষকদের সঙ্গে কিছু শিক্ষার্থীও অংশ নেয়। মৌনমিছিলটি বৃষ্টিতে ভিজে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আবারও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের সামনে এসে সমাবেশে মিলিত হয়। এ সময় বক্তব্য দিচ্ছিলেন শিক্ষকরা। এরই ফাঁকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা তিন শিক্ষার্থীকে আটক করে নিয়ে যেতে চায়। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা একত্রিত হয়ে পুলিশের কাছ থেকে তিন শিক্ষার্থীকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। পরে পুলিশের কাছ থেকে ওই শিক্ষার্থীদের ছিনিয়ে নেন শিক্ষকরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীদের পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার পর পুলিশকে উদ্দেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে যাওয়ার ব্যবস্থা আপনারা করবেন। যদি কোনো ছাত্রের গায়ে হাত পড়ে, আমরা কিন্তু এরপর আর কোনো দায়িত্ব নেব না। যদি আমাদের সহকর্মীদের গায়ে হাত পড়ে, এটা আমরা কিন্তু মেনে নেব না। এটা অত্যন্ত বাজে ঘটনা ঘটেছে। এভাবে কোনো শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যেতে পারেন না। এই শিক্ষার্থীদের নামে কোনো মামলা আছে? এভাবে ছোঁ মেরে মানুষকে তুলে নেওয়া, এটা কী? এর প্রতিবাদ করছি আমরা। এভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া শিবির বলেন আর যা–ই বলেন, এটা খুবই অন্যায়। এ কারণে আজ দেশের এই পরিণতি ঘটেছে। এটা মনে রাখতে হবে গত ১২ বছর ধরে এই কাজটাই করছেন ছাত্রলীগ ও আপনারা মিলে।’
ঘটনার সময় উপস্থিত গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, ‘এরা সাদা পোশাকের পুলিশ কি না, আমি জানি না। আমি তো চিনি না এদেরক। ওরা তো বলেনি আমাকে, আমি ডিবি। ওরা তো বলেনি গোয়েন্দা, ওরা তো বলেনি আমি রাষ্ট্রের পুলিশ। তারা কারা, আমি তো চিনি না। আমি তো গুণ্ডামি দেখলাম। আমি তো এখানে হাইজ্যাক করে ছেলেদের চ্যাংদোলা করে তুলে নিতে দেখলাম। এটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা যতক্ষণ বেঁচে আছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এটা হতে দেব না। এই বাহিনী কারা, আমরা এর জবাব চাই। আমি এদের পরিচয় চাই।’
ঘটনার সময় শিক্ষকদের মধ্যে আরও ছিলেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌভিক রেজা, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা, নাট্যকলার অধ্যাপক মো. হাবিব জাকারিয়া, কাজী শুসমিন আফসানা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাতিল সিরাজ, কাজী মামুন হায়দার, ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্ত্তী, সহযোগী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার মো. মাহমুদুল হাসান, আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহরিয়ার পারভেজ, মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাদেকা বানু, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকাটনিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সারাফাক হোসেন অভি, আর্কিটেকচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সামিউল সাব্বির ইসলাম, মানবিক (ইংরেজি) বিভাগের আহসান হাবীব প্রমুখ।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কয়েকজন বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের আহ্বানে এখানে এসেছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে যে আচরণ পুলিশ প্রশাসন করেছে, এটা অন্যায়। তাঁরা পুলিশকে কিছুই বলেননি।
এ দিকে শিক্ষার্থীদের আটকের ভিডিও করায় সমকালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি অর্পণ ধরকে ডিবি পুলিশ লাঞ্ছিত করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া ডেইলি ক্যাম্পাসের রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি আমজাদ হোসেনের আইডি কার্ড ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। তাঁর পিঠে কিল-ঘুষি মারা হয়েছে।
অর্পণ বলেন, ডিবির এক সদস্য তাঁকে কাছে ডেকে নিয়ে যান। পরে আরেকজন তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকেন। তিনি পরিচয় দেওয়ার পরও এই কাজ তাঁরা অব্যাহত রাখেন। এতে তাঁর হাতের একটি অংশ কেটে গেছে। পরে পরিচিত পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দিতে বলায় তাঁরা ছেড়ে দেন। ডিবি পুলিশের একজন বলছিলেন, ‘এই হচ্ছে বড় ইনফরমার। এরে ধর।’
আমজাদ হোসেন অভিযোগ করেন, তিনি ভিডিও করায় তাঁর আইডি কার্ড ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। কয়েকজন সদস্য তাঁর পিঠে একাধিক কিল-ঘুষি দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, শিক্ষকদের আন্দোলনে কিছু বাইরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এসেছিলেন। তাঁরা পুলিশের দিকে জুতো ছুড়ে মেরেছিল বলে তিনি জেনেছেন। পরে শিক্ষকদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েছেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে ওনারা শান্তিপূর্ণ ছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই আছেন। দুই–তিনজন শিক্ষার্থী বের হয়ে এসে আমাদের পুলিশের সঙ্গে হটটক করে। তাঁরা একজনের (পুলিশ) গায়ে হাত তুলছিল। তা–ই তাঁদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। ওরা ছাত্রও না, বহিরাগত। তাঁরা কেন হাত তুলতে গেল।’
তখন সাংবাদিকরা হেমায়েতুল ইসলামকে বলেন, ‘বাস্তবে এখানে তো এ ধরনের কিছু হয়নি। কিন্তু ডিবি কেন টানাহেঁচড়া করল?’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হেমায়েতুল ইসলাম একই কথা বলেন।