কী চলছে পুলিশে?
৫ আগস্ট। এদিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। এর আগে শিক্ষার্থী-জনতার সংঘর্ষে বেশ কয়েকদিন ধরে শতশত ছাত্র, শিশু ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মারা যান পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য। ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশ যখন জনতার হাতে, তখন নিরাপত্তার ভয়ে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকে পুলিশ। এমন এক পরিস্থিতিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নিয়োগ দেওয়া হয় মো. ময়নুল ইসলামকে। তিনি পুলিশকে নির্ভয় দিয়ে কাজে ফেরার নির্দেশ দেন।
গতকাল বিকেল ৪টায় পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের সব ইউনিটকে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে স্ব স্ব কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে। কিন্তু, মহানগর, জেলা পুলিশ ও থানা পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অনেকে কাজে যোগদান করেননি।
কাজে যোগদান না করাদের অধিকাংশের ধারণা—ওপর মহলের নির্দেশ মানতে গিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কারণে এখন কাজে ফিরলে নানা ঝামেলা হতে পারে। অথচ, চাকরি বাঁচাতে গিয়ে ওপরের নির্দেশ পালন ছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) থেকেও আহ্বান জানানো হচ্ছে কাজে যোগদানের জন্য। তবে, লালবাগ বিভাগের একটি থানার এক উপপরিদর্শক (এসআই) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা থানা পর্যায়ের পুলিশ সদস্য যারা আছি, আইজিপি মহোদয় আমাদের নির্দেশ দিয়েছে কাজে যোগদানের জন্য। কিন্তু, আমরা কোথায় গিয়ে যোগদান করব? আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কই? অফিসে বসার জায়গা কই? অস্ত্র-গুলি কই? ইউনিফর্ম কই? আইডি কার্ড কই? ডিউটি করব তার গাড়ি কই? ব্যক্তিগত গাড়িও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। অনলাইন জিডির কম্পিউটার-প্রিন্টার কই? এগুলোর ব্যবস্থা না করে যোগদান সম্ভব?’
ডিএমপির জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘ডিএমপির অনেক কর্মকর্তা কাজে ফিরেছেন। আশা করছি, বাকিরা দ্রুতই কাজে ফিরবেন। বিশেষ করে নতুন সরকারের শপথ হয়ে গেলে সব ধরনের জটিলতা ঠিক হয়ে যাবে। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনেকের মধ্যে ভয় বিরাজ করছে। এই ভয় কাটাতে হবে। এ জন্য নাগরিক সমাজসহ সবাইকে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করতে হবে।’
পুলিশ সদস্যদের হত্যার বিচার, রাজনৈতিক দলের অধীনে কাজ না করে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের দাবিসহ ১১ দফা সংস্কারের দাবিতে সিলেট পুলিশ লাইনসে আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এ বিক্ষোভ মিছিলে থাকা সিলেট মহানগর পুলিশ লাইনসে কর্মরত এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘কনস্টেবল থেকে পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তা পর্যন্ত আমরা অন্তত ৫০০ পুলিশ সিলেট পুলিশ লাইনসের মধ্যে মিছিল করেছি। পরবর্তীতে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে নিহতদের আত্মার মাকফিরাতে দোয়া কামনা হয়েছে।’
ওই পুলিশ সদস্যের দাবি, ‘আমরা এখনও আমাদের পুলিশের অনেক লাশের তথ্য পাইনি। আজ বাদ আসর পুলিশ লাইনসে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বালন হবে। আমাদের এ ধরনের কার্যক্রম চলমন থাকবে। এসব কারণে আমরা হুমকি-ধামকির শিকার হচ্ছি। কিন্তু, আমরা কানে নিচ্ছি না।’
জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার জাকের হোসেন খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আমার মহানগরের মধ্যে ছয়টি থানার কার্যক্রম চলছে। তবে, সব থানা থেকে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সাধারণ জিডি নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ লাইনসে বিক্ষোভ করছেন সদস্যরা। তারা সবাই লাইনসের ভেতরেই রয়েছেন। তাদের বাইরে দায়িত্বে নেওয়া যায়নি। এ ছাড়া ট্রাফিক পুলিশকে সড়কে নামানো যায়নি।’
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঝিনাইদহ জেলার একটি থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ঝিনাইদহের পুলিশ কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে। অধিকাংশ কনস্টেবল, এএসআই ও এসআইয়ের দায়িত্বে থাকা সব পুলিশ সদস্য বলছেন, আমাদের দাবি না মেনে নিলে কেউ দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছেন না। আমরা থানাতেই আছি। তবে, কাজে নামছি না। আমাদের এসপি অফিস থেকেও নির্দেশনা রয়েছে, নিজেদের নিরাপত্তা রেখে চলার জন্য।’
ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার (এসপি) আজিম উল আহসান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কর্মস্থলে ফেরার জন্য পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যে নির্দেশনা, তা আমরা সব জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। আমি প্রত্যাশা করছি, জেলার সব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে ফিরবেন।’
আপনার জেলার পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তাদের দাবি না মেনে নিলে তারা কর্মস্থলে ফিরবে না। আবার আপনি প্রত্যাশা করছেন তারা কর্মস্থলে ফিরবে। তার মানে আপনি এখনও নিশ্চিত নন, তারা কর্মস্থলে ফিরবেন? জবাবে আজিম উল আহসান বলেন, ‘তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তরা কনসার্ন। ফলে, স্টেপ বাই স্টেপ গিয়ে সবকিছুর সমাধান হবে বলে আমি মনে করছি।’
‘অর্থাৎ কর্মস্থলে ফেরার সিদ্ধান্ত হয়নি বলে আমরা ভাবব?’—প্রশ্নে আজিম উল আহসান বলেন, ‘সেটা বিকেলে বা রাতে জানাতে পারব।’
বিকেলে খুলনার একটি থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘চাকরি থাকুক আর না থাকুক, আমি এখন কর্মে ফিরব না। আমার জীবনের দাম আছে না? বড় বড় স্যাররা নির্দেশ দেবেন সর্বোচ্চ কঠোর হতে, আর যখনই পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেল, তখনই তারা উধাও। তাদের থেকে সামান্য সহযোগিতা আমরা পাইনি। অথচ, তাদের নির্দেশ তামিল করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকে না।’
আজ বৃহস্পতিবার পৌনে ৪টার দিকে খুলনা মহানগর পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোজাম্মেল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘খুলনার সদর ও খালিসপুর থানা পুলিশ সম্পূর্ণভাবে কাজ করছে। খুলনার অন্যান্য থানাগুলিতে পুলিশ সদস্যরা থানাতে অবস্থান করছেন। তবে, তারা থানার বাইরে যাচ্ছেন না। থানাতে থেকে তারা সাধারণ ডায়েরি বা চুরি-ছিনতাইয়ের জিডিগুলো নিচ্ছেন। তবে, আমি এখনও খুলনার ট্রাফিক পুলিশকে মাঠে নামাতে পারিনি।’
মোজাম্মেল হক দাবি করেন, ‘ডিএমপির রাজারবাগ কেন্দ্রীক যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সে সমস্যার সমাধান হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন ডিসি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সাধারণ হিসাব হচ্ছে, প্রতিটি মহানগর পুলিশের কমিশনার বা জেলা পুলিশ সুপার কিন্তু আওয়ামী লীগের নিয়োগ দেওয়া। তারা জানেন, কিছুদিন পর কেউ আর নিজ দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। ফলে, দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে তারা সতর্ক। নতুবা কিছুদিন পর তারা সবাই বিপদে পড়বেন। সুতরাং, দেশের সব পুলিশের একযোগে যোগদানের ব্যাপারটা বেশ জটিল।’