বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না : হাবিবুল আউয়াল
সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় আমাদের বিশ্বাস কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তি বিবর্জিত এবং প্রশাসন ও পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত, প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন হবে।
আজ বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগ ঘোষণা দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।
বিদায়ী সিইসি কাজী হাবুবুল আউয়াল বলেন, ‘আজকে আমাদের বিদায়লগ্নে, আপনারা জানেন দেশে একটা বড় ধরনের ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, এটা আমাদের দেশকে আগামীতে প্রবল সংস্কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে আরও সুন্দর একটি বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, আমরা সবাই আশাবাদী, সেই স্বপ্ন অচিরেই বাস্তবায়িত হবে। আগামী দিনের বাংলাদেশ সব বিষয়ে প্রশাসন, বিচার, নির্বাচন সবকিছুই অনেক সুন্দর হবে।‘
কাজী হাবুবুল আউয়াল বলেন, ‘দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচন নিয়েও ছিল অনেক বিতর্ক। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে, যার ফলাফল নিয়ে ছিল বিতর্ক। ১৯৯১ এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সূক্ষ্ম ও স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৭টি ও আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল আরও বলেন, ‘নিরাপদ প্রস্থান বা সেইফ এক্সিট প্রসঙ্গে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনা সমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দর-কষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সেই প্রশ্নে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের অনুরূপ অন্তর্বর্তীমূলক তথা ইনক্লুসিভ ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে, নির্বাচন ইনক্লুসিভ ছিল। এতে বিএনপি আসন পেয়েছিল মাত্র ছয়টি, পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’
সদ্য সাবেক সিইসি কাজী হাবুবুল আউয়াল বলেন, ‘২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে বা ব্যবস্থাপনায়। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধীদল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচন সেই অর্থে, অন্তর্ভূক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আন্তরিকভাবে আহ্বান করা সত্ত্বেও তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল আরও বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করা একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব বিষয়। নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। সেই কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন, নির্বাচন, কখন, কী কারণে, কতদিনের জন্য স্থগিত করা যাবে, তা-ও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনোই কোনো নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে কোনো কমিশন পদত্যাগ করেনি।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে, দলের মধ্যে নয়। ২৯৯টি আসনে ১৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নির্বাচন নিষ্পন্ন করা অতিশয় কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ ও দায়দায়িত্ব সবসময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সবসময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে গ্রহণযোগ্য, নির্ভেজাল নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘বিদ্যমান ব্যবস্থায় আমাদের বিশ্বাস কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তি বিবর্জিত এবং প্রশাসন ও পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত, প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন হবে।’
হাবিবুল আউয়াল আরও বলেন, ‘১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সব নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত, সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচনগুলো সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছে। জাতীয় ও স্থানীয় স্তরের সব নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালট পেপার প্রেরণ, কতিপয় উপনির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএমের ব্যবহার, দেশের সব জেলায় একইদিনে, তবে প্রতিটি জেলায় প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে পাঁচ থেকে ছয়টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল ইত্যাদি গৃহীত ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজন ছিল না। আমি স্পষ্ট করে বলছি, নির্বাচন যেহেতু একদলীয় ছিল, কাজেই এই নির্বাচনকে সরকারিভাবে প্রভাবিত করার আবশ্যকতা কার্যত ছিল না।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘নির্বাচন দলের ভেতরে হয়েছে, মধ্যে হয়নি। কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দু বছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদে ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি ও সিটি কর্পোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, শুদ্ধতা, নিরপেক্ষতা, অবাধ হওয়া নিয়ে অতীতের ন্যায় ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি। উপনির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে কমিশন নির্বাচন করেছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৌক্তিক, কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন না করে বা বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে, বা সেই কারণে নির্বাচন হয়নি, এমন কোনো দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ নেই।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘সরকার বারবার বলেছে, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সুপ্ত কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত। কমিশনের সদস্যরা সংবিধান মেনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমাদের কর্মকালে আমরা গণমাধ্যম, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীসহ আবশ্যক সবার আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। আমি আজ এই বিদায়লগ্নে, কৃতজ্ঞচিত্তে সেটি স্মরণ করছি। বর্তমান ও অতীত থেকে আহরণলব্দ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাবনা সরকারের সদয় বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া আমরা আমাদের কর্তব্য মনে করছি।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার (হোমোজিনিটি) কারণে সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বে মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিন বিরতি রেখে অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে আমাদের ধারণায় এটি ভবিষ্যতের জন্য উত্তম হবে। অধিকন্তু প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল আরও বলেন, ‘পরিশেষে আপনাদের অবহিত করতে চাই, আমিসহ মাননীয় অন্যান্য কমিশনাররা দেশের পরিবর্তিত, বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থির করেছি। আমরা আজই পদত্যাগপত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমীপে উপস্থাপনের নিমিত্তে কমিশনের সচিব মহোদয়ের হাতে দিব।’