গুম তদন্তে যেভাবে কাজ করবে কমিশন
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের হাতে ‘জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্তে’গঠিত তদন্ত কমিশন কাজ শুরু করেছে৷ এই লক্ষ্যে রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) প্রথম বৈঠক করেছে কমিশন৷
কমিশনের পাঁচ সদস্যের সবার উপস্থিতিতে প্রথম বৈঠকে তদন্তের প্রক্রিয়া কীভাবে শুরু হতে পারে সে বিষয়ে কিছু প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷ রাজধানীর গুলশানে কমিশনের জন্য একটি অস্থায়ী কার্যালয়ও তৈরি করা হয়েছে৷ কমিশনের সদস্যরা সেখানে দাপ্তরিক কার্যক্রম চালাবেন৷ প্রথম বৈঠকে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে৷
তার আগে গত ২৭ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে সরকার৷ কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন৷
এই কমিশনকে তদন্ত শেষ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে ৪৫ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়েছে৷ কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে৷
সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্তে এই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে৷
তদন্তের কর্মপরিকল্পনা
বেশ কয়েক বছর ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় থাকা বাংলাদেশের গুমের ঘটনার তদন্তে কমিশন কীভাবে কাজ শুরু করবে সে বিষয়ে প্রথম বৈঠকে উপস্থিত থাকা কমিশনের সদস্য নূর খান লিটনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান চেয়ে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে কমিশন৷ সেইসাথে যেকোনো ব্যক্তি যেন গুমের বিষয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাখা হবে৷ অর্থাৎ কমিশনের নিজস্ব তদন্তের কার্যক্রমের পাশাপাশি, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা ভুক্তভোগীর কাছ থেকে কোনো অভিযোগ এলে তাও বিবেচনায় নেবে কমিশন৷
ডয়চে ভেলেকে নূর খান লিটন বলেন, ‘‘প্রথম বৈঠকে আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম৷ সেখানে সর্বসম্মতভাবে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ প্রথমত আমরা গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করব৷ যেকেউ চাইলে কমিশনে এসে অভিযোগ দিয়ে যেতে পারবেন৷ একই সাথে কমিশন প্রয়োজন মনে করলে সারাদেশেই যাবে৷ গুমের শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার তদন্তে নেমে নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায় আছেন কিংবা তাদের সাথে কী ঘটনা ঘটেছে তা জানতে তৎপর হবে কমিশন৷”
কমিশনের সদস্য নূর খান আরও বলেন, ‘‘আমাদের কাজ মূলত গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে কথা বলা৷ পাশাপাশি যারা এখনো গুম হয়ে আছেন তারা কোথায় আছেন বা তাদের সঙ্গে কি হয়েছে সেটা খুঁজে বের করা৷”
এদিকে সরকার নির্ধারিত ৪৫ দিনের মধ্যে তদন্তের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে কি না সেই প্রশ্নে নূর খান জানান, নির্ধারিত সমযে কাজ শেষের চেষ্টা করে যাবে কমিশন৷ অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘‘প্রথমত আমরা চেষ্টা করব, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে৷ যদি না পারি, তাহলে সরকারের কাছে আমরা সময় বাড়াতে আবেদন করব৷ সেটা তো আর এখনই ঠিক করা যাবে না৷ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে৷”
বিশেজ্ঞদের পরামর্শ
গুমের ঘটনা তদন্তে কীভাবে কমিশন সফলভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে নানান পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও মানবাধিকার কর্মীরা৷ তাদের কেউ বলছেন, প্রথমে গুমের সংখ্যা নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে৷ আর গুম হওয়া ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যাওয়ার আইনগত ভিত্তি কী ছিল তা প্রকাশ করার কথা বলছেন কেউ কেউ৷ এর ফলে ভবিষ্যতে এধরনের ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা৷
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ধরনের কমিশনের কিন্তু মানবাধিকারের জন্য মাইলফলক৷ আমার মনে হয়, কমিশনের প্রথম কাজ হবে গুমের সংখ্যা নির্ধারণ করা৷ এরপর যারা গুম হয়েছেন তাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় কিছু সিসিটিভি ফুটেজও আছে৷ যেমন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে যখন হোটেল থেকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে কিছু সিসিটিভি ফুটেজ আমরা দেখেছি৷ এগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে৷”
প্রতেকটি ঘটনাকে ধরে ধরে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন এই মানবাধিকারকর্মী৷
প্রথমে কোন দিকে কমিশনের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উনাদের কাজের ক্ষেত্র বলে দেওয়া হয়েছে৷ উনাদের মূলত দেখতে হবে, যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে আইনগত যৌক্তিকতা কী ছিল৷ এটা জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে৷ এটা হলে দীর্ঘদিন ধরে দেশে যে গুমের ঘটনা চলছিল সেটা চিরতরে বন্ধ করা সম্ভব৷ কাউকে ধরে নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ বেআইনি ঘোষণা করতে হবে৷ পাশাপাশি গুম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যে আমরা সই করেছি, সেটা মাথায় রাখতে হবে৷”
এদিকে শুরুতেই কমিশনের কর্মপরিধির বিষয়েটি স্পষ্ট করে মানবাধিকারকর্মী, সংগঠন ও ভুক্তভোগী স্বজনদের সঙ্গে মতবিনিময় জরুরি বলেও মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা৷ তাদের মতে, বন্দিশালাগুলোর তথ্যপ্রমাণাদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংগ্রহ করা জরুরি৷
গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ‘আয়নাঘরের’ মতো অন্যান্য যেসব জায়গায় যারা বন্দি আছেন, তাদের মুক্তি ও গুম করে রাখার জন্য ‘আয়নাঘরের' মতো সব ঘর ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে৷
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে প্রত্যাশা জানতে চাইলে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘‘কমিশনের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে৷ তারা এখনও কাজ শুরু করেনি বলেই জানি৷ তারা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে থেকে কাজটা এগিয়ে নেবেন, বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালেই হয়তো যেতে হবে৷ কোন প্রক্রিয়ায় হবে সেটি এখনও আমরা জানি না৷ কমিশন নিশ্চয়ই তা আমাদের কাছে স্পষ্ট করবে৷”
গুমের ঘটনায় তদন্তের দাবি জানিয়ে ‘মায়ের ডাক’গত ১৮ আগস্ট বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ১৫৮ ব্যক্তির একটি তালিকা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে জমা দিয়েছে৷ এর আগে ২০২১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল৷
সেনাবাহিনীর আদালত গঠন
গুমের ঘটনা তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের আদালত গঠন করেছে সেনাবাহিনী৷ তারা অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির তদন্তও করবে৷ অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের ব্যাপারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘‘এ বিষয়ে তদন্ত চলছে৷ তাতে দোষী সাব্যস্ত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ প্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না৷ তদন্ত প্রক্রিয়াটি একটু ধীরগতিতে চলছে৷ এখানে বেশকিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে৷”
গুমের শিকার পরিবার ও মানবাধিকারকর্মীরা গুমের ঘটনায় র্যাব ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে অভিযুক্ত করে দীর্ঘদিন ধরেই বিচার দাবি করে আসছেন৷ এরইমধ্যে গুমের ঘটনা তদন্তে সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের আদালত গঠনের কথা জানা গেছে৷ যদিও সেনাবাহিনীর এই আদালত নিয়ে গুম কমিশনের কেউ কথা বলতে রাজি হননি৷
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়৷ এর পরদিন ৬ আগস্ট প্রায় আট বছর পর গোপন বন্দিশালা থেকে ছাড়া পান মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর কাসেম আলীর ছেলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)৷ একই দিনে পাঁচ বছরের বেশি সময় পর গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হন পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা৷
বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিল৷ যদিও শেখ হাসিনা সরকার সেই বিষয়টি আমলে নেয়নি৷ গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও বিচার পাননি৷ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়৷ এরপর ৩০ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ৷
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তিতে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া বার্তায়ও ‘গুম সংস্কৃতির’ সমাপ্তি ঘটানোর অঙ্গীকারের কথা বলা হয়৷ ‘আয়নাঘর’নামে পরিচিতি পাওয়া গোপন বন্দিশালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ এরই প্রেক্ষাপটে ২৭ আগস্ট গুমের ঘটনার তদন্তে এই কমিশন গঠন করে ড. ইউনূসের সরকার৷
তবে কমিশনের এই কার্যপরিধিকে আরো স্পষ্ট করা এবং এর ব্যাপ্তি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা উঠেছে৷ মানবাধিকার কর্মীদের মতে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ৷ সরকারের গঠিত এই কমিশনের মূল কাজ হওয়া উচিত গুমের পরিকল্পনা, নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা৷