নানা ঘটনায় আলোচিত আদালতপাড়া
আজ শুক্রবার (৮ নভেম্বর)। তিন মাস আগের এই দিনে শপথ নিয়েছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সময়ে অনেক অনেক ঘটনার মধ্যে আলোচিত ছিল আদালতপাড়াও। গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের নেতারা চলে যান আত্মগোপানে। বিভিন্ন মামলায় লুকিয়ে থাকা এসব নেতারা হন গ্রেপ্তার। পরে আদালতে আনা হলে জনতার রোষানলে পড়েন আওয়ামী লীগনেতা ও তাদের সমর্থকেরা। ‘ভিআইপি আসামি’ খ্যাত অনেকের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। তাদের নেওয়া হয় রিমান্ডে। আবার রিমান্ড অবস্থায় জামিনের ঘটনাও ঘটে।
একই সময়ে হামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে গা ঢাকা দেন বেশ কিছু আওয়ামীপন্থি আইনজীবী। আবার আদালত প্রঙ্গণে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্লোগান দিয়েও কেউ কেউ হয়েছেন নিন্দিত।
আদালতে ডিম নিক্ষেপ
গত ১৪ অক্টোবর সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনা সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) কোর্টে হাজির করা হয়। এরপরে তাদের উপরে আদালতে ডিম নিক্ষেপ করা হয়। এ ছাড়া গত ৭ অক্টোবর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের (সিএমএম) সামনে সাবেক সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ও সাবেক নিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলামের ওপর ডিম নিক্ষেপ করা হয়।
নিম্ন আদালতে রদবদল
গত ৫ আগস্টের পরে ঢাকার নিম্ন আদালতে বিচারকের ব্যাপক রদবদল হয়। আদালতে বিগত সরকারের আমলে কর্মরত প্রায় সব বিচারককে বদলি করা হয়।
আদালতের জিআর শাখায় রদবদল
আদালতের জিআর শাখায়ও ব্যাপক রদবদল হয়েছে। এখানে ১৫ বছর ধরে অনেক পুলিশ সদস্যও কাজ করে যাচ্ছিলেন। দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে আদালতের জিআর শাখায় দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। আদালতের আইনজীবীরা-বিচারপ্রার্থীদের বিভিন্ন সেবা নেওয়ার জন্য অনির্ধারিত বিভিন্ন টাকা দাবি করা হতো। জিআর শাখায় বদলীর ফলে আদালতে দুর্নীতি এখন কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।
আদালতের পিপি নিয়োগ নিয়ে আন্দোলন
ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে এহসানুল হক সমাজীকে পিপি নিয়োগ দেওয়ার পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ১/১১ এর সময়ও পিপি হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। পরে আইনজীবীদের ক্ষোভের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন।
আদালতে নতুন পিপি নিয়োগ
নিম্ন আদালতে আওয়ামীলীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত পিপিদের নিষ্ক্রিয়তা কারণে বিচারকাজে স্থবিরতা দেখা দেয়। এরপরে নতুন পিপি নিয়োগের জন্য বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা দাবি জানালে অবশেষে গত ১৫ অক্টোবর ঢাকার আদালতে ৬৬৯ পিপি-জিপি নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপরে আদালতে কার্যক্রম চলমান হয়।
বিদেশে পালানোর নাটক, অবশেষে কাঠগড়ায় ব্যারিস্টার সুমন
দেশবাসী সবাই জানত, ব্যারিস্টার সুমন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। অথচ, হঠাৎই তার গ্রেপ্তার নিয়ে দেশে পড়ে যায় শোরগোল। সব নাটকীয়তা ভেঙে তাকে দেখা যায় আদালত প্রাঙ্গণে। তখন তার হাতে হ্যান্ডকাফ, মাথায় হেলমেট ও বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা। তাকে দেখতে আগেই আদালতপাড়ায় নামে উৎসুক জনতার ভিড়; ছিলেন আইনজীবী, আদালতের কর্মচারী, বিচারপ্রার্থীরাও। সেখানে ব্যারিস্টার সুমনকে দেখে অনেকে ‘চোর চোর’ স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাহাসও হতে দেখা যায়।
রিমান্ডের আসামি জামিন পাওয়ায় সমালোচনা
সাবেক সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীকে রিমান্ড থাকা অবস্থায় জামিন দেওয়া হয়। গত ৮ অক্টোবর রাজধানীর পৃথক ছয় মামলায় জামিন পান সাবের হোসেন চৌধুরী। এ নিয়ে আদালত পাড়ায় রাষ্ট্রপক্ষ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায়। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তার এই জামিন নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যেও চলে আলোচনা সমালোচনা।
অনেক আইনজীবীর দেখা মিলছে না আদালত পাড়ায়
গত ৫ আগস্টের পরে অনেক আইনজীবীর দেখা মিলছে না আদালতপাড়ায়। অনেকে বলছেন, আওয়ামীপন্থি আইনজীবী হওয়ায় তারা গা ঢাকা দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ দাবি করছেন—তারা এখন আদালতছাড়া। দীর্ঘদিন আদালত প্রাঙ্গণে না আসাদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরু। তিনি পল্টন থানার একটি হত্যা মামলার আসামি। ৫ আগস্টের পর তাকে আর আদালতপাড়ায় দেখা যায়নি। এই তালিকায় আরও আছেন ঢাকা মহানগর সাবেক পিপি আব্দুল্লাহ আবু, আইনমন্ত্রী আনিসুলের ঘনিষ্ঠ বাহার উদ্দিন বাহার, ঢাকা বারের সাবেক সেক্রেটারি ফিরোজুর রহমান মন্টু, সাহাদাত শাওন, জোবায়ের রহমানও। বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউর রহমান, ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মামুন, দুদকের সরকারি কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল, ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি আবদুর রহমান হাওলাদার, মাহবুবুর রহমান, আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদলকেও দেখা যায়নি গণঅভ্যুত্থানের পর।
ভিআইপিদের পক্ষে লড়ছেন আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন
এর আগে আদালতপাড়ায় ততোটা পরিচিত মুখ ছিলেন না আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন। গত ৫ আগস্টের পরে আসামিদের পক্ষে যখন তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছিল না, তখন পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন এই মোরশেদ। ভিআইপি আসামি খ্যাতদের পক্ষে একের পর এক লড়ে চলেছেন তিনি।
মোরশেদ হোসেন শাহীন তিনি ঢাকার বারের সদস্য। ২০১২ সালে তিনি ঢাকা বারে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি হয়ে মামলা পরিচালনা শুরু করেন।
মিডিয়ার ব্রিফে লাঞ্ছিত আইনজীবী মোরশেদ
গত ২২ অক্টোবর আদালত চত্বরে ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের মামলার শুনানি শেষে গণমাধ্যমে ব্রিফের সময় পিছন থেকে এক আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীনের ওপর অনেকে চড়াও হন। এ সময় বলেতে শোনা যায়, আসামি পক্ষের আবার কীসের ব্রিফ? এ ঘটনা সমালোচনার জন্ম দেয়।
মোরশেদ আলম শাহিন এনটিভি অনলাইকে বলেন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বাদী এবং আসামিপক্ষে আইনজীবী থাকতে হয়। আমি শুধু আমার পেশাগত কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এই পর্যন্ত ৭০ জন আওয়ামী লীগের হেবি ওয়েট আসামির পক্ষে মামলা পরিচালনা করছি। মামলা পরিচালনা করার সময় আমার ওপরে বিভিন্ন সময়ে হুমকি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যারিস্টার সুমনের মামলা করার সময় আমাকে মারধর করা হয় এবং আমার সিনিয়র শেখ ফরিদকে আক্রমণ করা হয়েছিল। তবে এখন আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যদিও আমি মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের কাছে আমার নিরাপত্তা দাবি করছি।’