দেশ সংস্কারে নানা উদ্যোগ, আছে সংকট মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। পরে সুপ্রিমকোর্টের রেফারেন্স নিয়ে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। আজ মঙ্গলবার তার তিন মাসপূর্তি।
দায়িত্ব নিয়েই প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা হয়ে ওঠে এই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। সঙ্গে ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। আভ্যন্তরীণ নানামুখী ইস্যুকে করতে হয়েছে অতিক্রম। এমনকি, সরকারকে নিশ্চিহ্ন করতে জুডিসিয়াল ক্যু, প্রশাসনিক ষড়যন্ত্র, আনসার বিদ্রোহ, সংখ্যালঘু ইস্যু, গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা, পোশাকখাতে নৈরাজ্য ছিল অন্যতম ষড়যন্ত্র। এসবে যখন পার পেয়ে যায় অন্তর্বর্তী সরকার, তখন পাহাড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে টলাতে চলে অপচেষ্টা। যদিও ধৈর্যের সঙ্গে সব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এগিয়ে চলেছে এই সরকার।
লুটপাটে ফোকলা দেশ সামলাতে নানা কমিশন
লুটপাট করে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে রেখে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসবের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামকে কমিয়ে আনা এই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অনিয়ম দুর্নীতি রোধে করা হয়েছে সংস্কার কমিশন। ছয়জনকে ছয়টি কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এজন্য। নির্বাচন সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব সংস্কার নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কাজ করছে।
ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা-প্রতিশ্রুতি
দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে ড. ইউনূসের উপস্থিতি বিশ্বে বাংলাদেশকে অনন্য মর্যাদার আসনে নিয়ে যায়। বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সহযোগিতারও প্রতিশ্রুতি দেন তারা। বাংলাদেশ প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের বাজেট বাস্তবায়নের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পায়। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইএমএফ, ইউএসএইড, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
ড. ইউনূসের হাতকে শক্ত করতে পাশে দাঁড়ান প্রবাসীরা
শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের দাবিতে যারা রেমিট্যান্স বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন, সেই প্রবাসীরাই ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে পাশে দাঁড়ান রেমিট্যান্স পাঠিয়ে। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে একযোগে দেশে আসতে থাকে প্রবাসী আয়। এমনকি, ভয়াবহ বন্যায় সরকারকে বিদেশের কাছে হাত পাততে হয়নি। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে রিজার্ভ এখন দিনদিন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে, চলতি বছরের গত তিন মাসে (আগস্ট থেকে অক্টোবর) প্রবাসী আয় এসেছে ৭০২ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। আগের বছরের (২০২৩ সাল) একই সময় (আগস্ট থেকে অক্টোবর) প্রবাসী আয় এসেছিল ৪৯০ কোটি ৫২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এই সময়ের মধ্যে প্রবাসী আয় বেড়েছে ২১১ কোটি ৮১ লাখ ১০ হাজার ডলার বা ৪৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।
শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতা কাটিয়ে ক্লাস পরীক্ষা চালু
দেশের শিক্ষাঙ্গনেও ছিল অস্থিরতা। সেসব অস্থিরতা কাটিয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা চালু করেছে এই সরকার। যদিও এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানে মাঝেমধ্যেই অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে কারণ হিসেবে অনেকের দাবি, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বসে আছেন পতিত সরকারের অনুগতরা। ফলে তাদের ষড়যন্ত্রে এসব পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
যৌক্তির দাবি ও অযৌক্তিক দাবির পার্থক্য বুঝে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা
সাড়ে ১৫ বছরের অত্যাচারে মুখ বন্ধ করে রাখারা অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে নামেন। যৌক্তিক এসব দাবিকে আমলে নেয় সরকার। শিক্ষার্থীদের নানা দাবি শোনেন উপদেষ্টারা। যুক্তির প্রেক্ষিতে তা মেনে বা আংশিক মেনে এগিয়ে নিতে থাকেন দেশ। তবে, আওয়ামী লীগ সরকারের পর থেকে থমথমে ছিল দেশের পরিবেশ। পিঠ বাঁচাতে মুখ লুকিয়েছিলেন পতিত সরকারের দোসররাও। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের পরপরই ধীরে ধীরে নানা দাবি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকন তারা। সেসব দাবিকে বিশ্লেষণ করে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দেয় এই সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, রুখে দেয় ষড়যন্ত্র। কাজে দেয়নি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা। এখনও অস্থিরতা থাকলেও সরকার সামাল দিয়ে নিয়েছে পোশাকখাতকেও। সব মিলিয়ে এখন যে সব ষড়যন্ত্র থেমে গেছে, তা নয়। তবে, প্রেক্ষাপট বলছে—সরকারও সেসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় এখন বেশ সক্ষমতা অর্জন করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় করতে পদক্ষেপ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া জনপ্রশাসন, পুলিশ, ব্যাংক ও শিক্ষাখাতে অস্থিরতা কাটাতে কাজ করছে সরকার। অনেকটাই পুনর্গঠিত বিচার বিভাগও। যদিও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, কল-কারখানা অচলায়তন, বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। এসব মোকাবিলা করে ড. ইউনূস সরকারকে পুরোপুরি সফল হতে সময় লাগছে।
অভিযোগ রয়েছে, পুরোনো সরকারের আমলারা সরকারকে ঠিকমতো সহযোগিতা করছেন না। এ ছাড়া পদোন্নতি ও দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে সরকারি চাকরিজীবীরা। অন্যদিকে প্রশাসনের লোকদের দুর্নীতির অভিযোগও সামনে আসছে. যা সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে।
খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতকে সচল করতে উদ্যোগ
ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ। বিগত ১৫ বছরে প্রথমে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে-বেনামে ব্যাংকঋণের মাধ্যমে অর্থ লুটপাট, পি কে হালদার, এস আলম গ্রুপ, দরবেশখ্যাত এফ সালমান রহমানের ব্যাংক জালিয়াতির মাধ্যমে লুটপাট, অর্থপাচার, অর্থ কেলেঙ্কারি সর্বকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। তাদের কারণেই ব্যাংকগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জুন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আকাশ ছোঁয়া। বেহাল আর্থিক খাত নিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনে এখন মনোযোগী। তারল্য সংকট, সুশাসনের অভাবসহ একাধিক সমস্যায় ভোগা ব্যাংকগুলো তৈরি হচ্ছে পরিকল্পনা। এরইমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক বদলের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এর প্রথম ধাপ।
প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদলরের মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তোরণের চেষ্টা
ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনমাসে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদল করেছে সরকার, যা এখনও চলমান আছে। আর্থিকখাতসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে সংস্কার উদ্যোগ। স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে প্রশাসক। এদিকে কর্মবিরতি ও হামলার ভয় কাটিয়ে আবারও মাঠে ফিরেছে পুলিশ।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে নানা পদে বসানো হয়েছে নতুন কর্মকর্তাদের। দুর্নীতিবাজ অনেক কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, অনেককে করা হয়েছে ওএসডি। পরিবর্তন করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতও।
পুঁজিবাজারের অনিয়ম ঠেকাতে তদন্ত কমিটি
পুঁজিবাজারে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। ২০ অক্টোবর এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর মেয়াদে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো পুঁজিবাজারেও অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। এ সময়ে অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় অস্তিত্বহীন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারের জন্য আজ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমেই এসব কোম্পানির আসল চেহারা প্রকাশিত হচ্ছে। অন্যদিকে এই বাজারে লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তির, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ফ্লোর প্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমায় নানা কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের এ অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এখন ওই কৃত্রিম চেষ্টা না থাকায় ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি, কারসাজির অনিবার্য পরিণতি এখন আগের চেয়েও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণসহ নানা উদ্যোগ
স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালী করতে গঠন করা হয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কালাকানুন বাতিল করার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সইও করা হয়েছে।
বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক ড. ইউনূসের বৈঠক, ভাবমূর্তির উন্নয়ন
সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার বিরল সুযোগ পেয়েছেন। নানা কারণে প্রধান উপদেষ্টার এ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি সংকট ছিল, এ সফরে সেটি কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। চার দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ ১২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।