দেশ গঠনে নতুন নেতৃত্ব, নতুন আশা
২০২৪ সাল। বছরটা বাংলাদেশের রাজনীতির পটভূমিতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরশাসন পতনের মাধ্যমে হয়েছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। স্বাধীনতার পঞ্চম বছরের আগস্টে সেনা অভ্যুত্থানে পতন হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের, আর এবার গণঅভ্যুত্থানে তারই মেয়ে শেখ হাসিনার হয়েছে পতন। এরমধ্যে স্বৈরশাসনের অবসানে আরও একবার রাজপথে নেমেছিল ছাত্র-জনতা। ২০২৪ সালের মতো সেবারও, অর্থাৎ ১৯৯০ সালে জেহাদ নামে এক ছাত্রের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। এতে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। ছড়িয়ে পড়ে জনরোষ। পতন হয় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে জনগণের সেবা করতে আসে। প্রায় ১৬ বছর ধরে চলছিল তাদের শাসন। দীর্ঘ এই সময়ে হয়েছে নানা অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি ও অপশাসন। এতে বিন্দু বিন্দু করে জনমনে জমাট বাঁধে রাগ, ক্ষোভ। এতে জনতা নতুন করে পেতে শুরু করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস, নিজের অধিকার আদায় করে নেওয়ার ইচ্ছা। বাকি ছিল শুধু প্রতিবাদ শুরু করাটা। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে সেটা করে এদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে অধিকার আদায়ে নেমে শেখ হাসিনা সরকারের নানা নিপীড়নে ও হত্যাযজ্ঞে গড়ে তোলেন প্রতিবাদের বুহ্য, সেই লড়াইয়ে হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে ৫ আগস্ট পতন হয় সরকারের। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে বাংলাদেশে থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতের দিল্লিতে নেন আশ্রয়।
এরপর দেশে আসে নতুন নেতৃত্ব। শিক্ষার্থীদের আহ্বানে দেশের হাল ধরেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৮ আগস্ট শপথ নেয় তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ৩৬ জুলাই খ্যাত ৫ আগস্টে জয়ী হয়ে মানুষের মনে সৃষ্টি হয় অধিকার ফিরে পাবার আশা। সেই আশা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্যের দিকে তাকিয়ে আছে আপামর জনগণ।
যেভাবে শুরু হয় আন্দোলন
সব ধরনের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকার একটি পরিপত্র জারি করে। পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সব কোটা বাতিল করা হয়েছিল। এ বছরের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সরকারি পরিপত্রটিকে অবৈধ ঘোষণা করে। এরপরই কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় আসে।
শেখা হাসিনার বক্তব্যে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ সম্বোধন
শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন। সেই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আরও চাঙা হয়ে উঠেন। এর পরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। হয় অনেক মামলা-হামলা।
আবু সাঈদকে হত্যা
১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিষয়টি সরসাসরি দেখানো হয়। বিশেষ করে এনটিভিতে ঘটনাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখানো হয়েছিল। এরপরই আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের দমননীতির কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে অনেক শিশু-কিশোর-যুবককে। এতে জনমনে জমতে থাকা ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়ে যায়। আন্দোলন থেকে জানানো হয় কয়েক দফা দাবি। ছাত্র-জনতার চাপে ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে ও সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। তবে, রক্তের দাগ ভুলে যায়নি শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। সেখান থেকে একটাই দাবি ওঠে—শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
৫ আগস্ট : স্বৈরশাসনের পরাজয়
৫ আগস্ট এক দফা দাবির প্রেক্ষিতে সম্মিলিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরই মধ্য দিয়ে তার প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
নতুন নেতৃত্ব
ছাত্র-জনতার আহ্বানে ৮ আগস্ট দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশে তৈরি হয় অন্তর্বর্তী সরকার, যাদের লক্ষ্য দেশের সবগুলো ভঙ্গুর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, যত অনিয়ম-দুর্নীতি-অন্যায়-অবিচার সব নির্মূল করা।
সংকট-বিপর্যয় মোকাবিলার নতুন শক্তি, নতুন আশা
দায়িত্ব নিয়েই প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা হয়ে ওঠে এই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। সঙ্গে ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। আভ্যন্তরীণ নানামুখী ইস্যুকে করতে হয়েছে অতিক্রম। এমনকি, সরকারকে নিশ্চিহ্ন করতে জুডিসিয়াল ক্যু, প্রশাসনিক ষড়যন্ত্র, আনসার বিদ্রোহ, সংখ্যালঘু ইস্যু, গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা, পোশাকখাতে নৈরাজ্য ছিল অন্যতম ষড়যন্ত্র। এসবে যখন পার পেয়ে যায় অন্তর্বর্তী সরকার, তখন পাহাড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে টলাতে চলে অপচেষ্টা। সর্বশেষ সচিবালয়ে লাগে ভয়াবহ আগুন। এতেও পাওয়া গেছে নাশকতার ইঙ্গিত। যদিও ধৈর্যের সঙ্গে সব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এগিয়ে চলেছে এই সরকার।
লুটপাট করে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে রেখে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসবের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামকে কমিয়ে আনা এই সরকারের ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে শীতকালীন শাক-সবজির দাম এসেছে হাতের নাগালে। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনও কমানো সম্ভব হয়নি। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি শুল্কও মওকুফ করেছে সরকার। এ ছাড়া দেশের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে করা হয়েছে ছয়টি সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলোও তাদের প্রতিবেদন প্রস্তুত করছে দেশের সংস্কারের জন্য।
দেশের শিক্ষাঙ্গণে যে অস্থিরতা ছিল সেসব কাটিয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা চালু করেছে এই সরকার। প্রায় ১৬ বছরের অত্যাচারে মুখ বন্ধ করে রাখা অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে নামেন। যৌক্তিক এসব দাবিকে আমলে নেয় সরকার। শিক্ষার্থীদের নানা দাবি শোনেন উপদেষ্টারা। যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তা মেনে বা আংশিক মেনে এগিয়ে নিতে থাকেন দেশ। যেসব দাবি ছিল অযৌক্তিক-স্বরযন্ত্রমূলক, সেসব দাবিকে বিশ্লেষণ করে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দেয় এই সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, রুখে দেয় ষড়যন্ত্র। কাজে দেয়নি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। জনপ্রশাসন, পুলিশ, ব্যাংক ও শিক্ষাখাতে অস্থিরতা কাটাতে কাজ করছে সরকার। অনেকটাই পুনর্গঠিত বিচার বিভাগও। ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটই ছিল খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ। বিগত ১৫ বছরে প্রথমে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে-বেনামে ব্যাংকঋণের মাধ্যমে অর্থ লুটপাট, পি কে হালদার, এস আলম গ্রুপ, দরবেশখ্যাত সালমান এফ রহমানের ব্যাংক জালিয়াতির মাধ্যমে লুটপাট, অর্থপাচার, অর্থ কেলেঙ্কারি সর্বকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জুন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল আকাশ ছোঁয়া। বেহাল আর্থিক খাত নিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনে বেশ মনোযোগী। তারল্য সংকট, সুশাসনের অভাবসহ একাধিক সমস্যায় ভোগা ব্যাংকগুলো তৈরি হচ্ছে পরিকল্পনা। এরইমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক বদলের মাধ্যমে শুরু হয়েছে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
পুঁজিবাজারে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ছাড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালী করতে গঠন করা হয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কালাকানুন বাতিলের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সইও করা হয়েছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার বিরল সুযোগ পেয়েছেন। অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ ১২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। এ ছাড়া সরকারের আহ্বানে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশ সফর করেছেন।
এ সরকারের কাছে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্খা অনেক। সমাজের প্রতিটি জায়গায় ন্যায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা সবার। সে লক্ষ্যে কাজও করছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার।