‘ডামি’ নির্বাচনের এক বছর
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ‘একতরফা’ সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৪৩টি আসন পায়। একই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৮টি আসন পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। এমন অবস্থায় সবার মনে প্রশ্ন ছিল— পরবর্তী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটবে? সাধারণ নাগরিকরা কি ভোট দিতে পারবেন?
রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি কি এই নির্বাচনে অংশ নেবে? কিংবা সাধারণ জনগণ কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে পারবে? এমন সব আলোচনা ও শঙ্কার মধ্যে রাজনীতির মাঠ ছিল চরম উত্তপ্ত।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগের কথা, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর। সারা দেশের নজর তখন রাজধানীর পল্টন-মতিঝিল এলাকায়। কারণ, সেদিন বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগ প্রায় একই স্থানে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। ত্রিমুখী সেই কর্মসূচি ঘিরে সর্বমহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বেশিরভাগ মানুষের চিন্তা-চেতনা এমন ছিল, আজ কিছু একটা হতে চলেছে।
অবশেষে সেই শঙ্কাই সত্যি হয়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, প্রাণহানি ও হরতাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ২৮ অক্টোবর। সংঘর্ষের শুরুটা হয় মূলত দুপুরের দিকে। মগবাজার থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিকআপে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে নিজেদের সমাবেশস্থলের দিকে যাচ্ছিল। কাকরাইল মোড়ে পৌঁছানোর আগে সেখানে অবস্থানরত বিএনপির নেতাকর্মীদের কারণে পিকআপটি গুলিস্তানের দিকে যেতে পারেনি। এ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে।
কাকরাইল মোড়ে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। কাকরাইলে পুলিশবক্সে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরপর পুলিশ ব্যাপকভাবে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ সংঘর্ষে যুক্ত হয় বিজিবি, র্যাবও। এরপর থেকে টানা সংঘর্ষ চলতে থাকে। এ সংঘর্ষে একজন করে পুলিশ সদস্য ও যুবদল নেতা নিহত হন। ফলশ্রুতিতে পণ্ড হয় বিএনপির মহাসমাবেশ। যদিও সেদিন জামায়াত শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করে। এ দিনের পর থেকে সরকারি কাজে বাধাদান ও পুলিশকে হত্যার অভিযোগে বিএনপির জ্যেষ্ঠ অধিকাংশ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণই করতে পারেনি। সে সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘরে পর্যন্ত ঘুমাতে পারত না। পালিয়ে বেড়াত।
বিএনপির অভিযোগ, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ মিলে ইচ্ছেকৃতভাবে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড করতে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়। এ ঘটনার পর আওয়ামী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, ‘বিএনপি খেলা শুরুর আগেই বোল্ড আউট হয়েছে। তারা ঢাকা দখল নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের নেতাকর্মী পালিয়ে গেছে।’
অভিযোগ ছিল, বিএনপির নেতাকর্মীদের কারাগারে নেওয়ার পর সরকার এবং সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বিএনপির কিছু নেতাকর্মীকে প্রলোভন দেখান, যেন তারা এককভাবে বা দলগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এ বিষয়ে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর এ প্রতিবেদক বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে জানতে চান, ‘কাউকে কাউকে নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টার এ অভিযোগ কি সত্য?’ জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, ‘অবশ্যই সত্য ছিল। শাহজাহান ওমর তো আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেনই। তবে এ ব্যাপারে আলাপ করতে আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি সরকার।’
এরপর ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী (২০২৪ সালের) ৭ জানুয়ারি। তবে সে সময়কার সংঘাতময় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সিইসি বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক মতানৈক্যের সমাধান প্রয়োজন। আমি সব রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ করব, সংঘাত পরিহার করে সমাধান অন্বেষণ করুন। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা-সমাধান অসাধ্য নয়।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কী হতে যাচ্ছে, মূলত তা নির্ধারণ হয়ে যায় ২৮ অক্টোবরই। কারণ, বিএনপি সেদিনই রাজনীতির মাঠ থেকে আউট হয়ে যায়।
এমন এক পরিস্থিতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলীয় লোকজনকে ডেকে দ্বাদশ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার তাগিদ দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ পাস করে আসতে পারবেন না। অন্য দলের প্রার্থী না থাকলে প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখতে হবে।’
ওই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ছিল ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু সে সময় বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী কারাগারে। ফলে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি বিএনপিসহ তাদের সমমনারা।
অংশগ্রহণ করেনি জামায়াতে ইসলামীও। শুধু যে বর্জন করেছিল, তা নয়। নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণাও দেয় তারা। সে অনুযায়ী বিএনপি ও তাদের সমমনারা লিফলেট বিতরণ ও প্রচারণা চালাতে থাকে।
ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হয়। নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে লড়াই করেন ১ হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেন ৪৩৬ জন। নির্বাচনি প্রচারণার মধ্যে মূলত আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ও তাদের ডামি প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত দেশ-বিদেশে এ নির্বাচন ‘ডামি’ নির্বাচন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। নওগাঁ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল হকের মৃত্যুর কারণে ওই আসনের ভোটগ্রহণ বাতিল করে ইসি। আর ভোটগ্রহণের দিন ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের একটি কেন্দ্রের ভোট বাতিল হওয়ায় ওই আসনের ফলাফল স্থগিত করে ইসি।
ফলে ওই ২৯৮টি আসনের চূড়ান্ত বেসরকারি ফলাফল জানানো হয় ইসি থেকে। ফল অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ২২২টি আসনে, জাতীয় পার্টি (জাপা) ১১ আসনে এবং জাসদ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি একটি করে আসনে জয়ী হয়েছে। আর ৬২টি আসনে জয়ী হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। মূলত এ ৬২ জনের অধিকাংশ ডামি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের অবস্থান ভালো থাকার কারণে তারা জয়ী হন।
ভোটগ্রহণের দিন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ভালো নির্বাচন হয়েছে। আমি এতটা আশা করিনি। এ নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।
সেই ‘ডামি’ নির্বাচনের এক বছর হলো আজ, যার মাধ্যমে টানা চারবারের মতো ক্ষমতায় বসেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সেই সরকারের সাত মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় স্বৈরাচারী সরকারের। দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। পালিয়ে যান তার দলের বেশিরভাগ শীর্ষনেতা।