বাবা আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে বলেছিল

‘বাবা আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে বলেছিল। কিন্তু আর আসেনি।’ শহীদ বিপ্লবের মেয়ে আমিনার কথা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ঢাকার বাইপাইলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন নওগাঁর বিপ্লব মণ্ডল (৩৩)। তিনি সদর উপজেলার শিমুলিয়া মণ্ডলপাড়ার লুৎফর মণ্ডলের ছেলে। ঢাকার বাইপাইল এলাকায় একটি সেলুনে কাজ করতেন।
শহীদ বিপ্লবের বাবা লুৎফর মণ্ডল বলেন, গত ৪ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে বিপ্লব তার ছোট ভাই ফিরোজকে ফোনে না পেয়ে ফোন দেয় আমাকে। বলে, আব্বা তুমি গ্রামের বাইরে কাজ করতে যেও না। ছোট ভাইকেও কাজে যেতে দিও না। তোমরা সাবধানে থেক। কেউ ডাকলে যাবে না। দেশের অবস্থা ভালো না। ঢাকায় গণ্ডগল হচ্ছে। আমার জন্য চিন্তা করো না। বাবা তুমি মা ও ছোট ভাইকে দেখে রেখ। তাদের যেন কিছু না হয়। এগুলো ছিল তার শেষ কথা।
লুৎফর মণ্ডল আরও বলেন, এরপর ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি ঢাকায় ব্যাপক গণ্ডগল হচ্ছে। কিছু ভালো লাগছে না। জোহরের নামাজের আগে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। তখন বউমাকে ফোন দিলাম তখন বউ মা বলল; মনে হয় আপনার ছেলে দোকানে গেছে। বউ মাকে বললাম বিপ্লব কি আন্দোলনে গেছে। উত্তরে বলে; সব কথা তো আমাকে বলে না বাবা। চিন্তা আরও বেড়ে গেল। বিপ্লবের মাকে বললাম, ভাত দাও। ভাত খেয়ে নামাজে যাব। তখন মনটা ছটফট করছে। ভাত না খেয়ে নাড়াচাড়ে করতে করতে বড় মেয়ে মিমিকে ফোন দিলাম। মিমি বলল, আমি ভাইয়ের বাসাতে গিয়ে তোমারে বলছি। বিপ্লবের মাকে বললাম আগে ছেলের সঙ্গে কথা বলব, তারপর ভাত খাব। অনেকক্ষণ পর মিমি বলল আব্বা তোমার ছেলের ফোন বন্ধ। পাওয়া যাচ্ছে না। তার বন্ধুরা বলল, বিপ্লব ভাইকে গুলি করেছে পুলিশ। তখন আমি মিমিকে বললাম তোর ভাইয়ের লাশের খোঁজ কর মা। তখন বিকেল ৫টা বাজে। মেডিকেলে খোঁজ কর মরদেহ পাওয়া যাবে। না কি মরদেহ গণকবর দিয়েছে। তখন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বিপ্লবের মরদেহের খবর কেউ দিতে পারেনি। পরের দিন ৬ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে শেখ ফজিলাতুন নেছা মেডিকেলে বিপ্লবের মরদেহের খোঁজ পায়।
হাউ-মাউ করে কাঁদতে লুৎফর মণ্ডল আরও বলেন, তবে হাসপাতাল থেকে মরদেহ আনা মুশকিল ছিল। তারা দিতে চাচ্ছিল না। হাসপাতালের লোকজন বলেছে মরদেহের কোনো কাগজ দিবে না। জোর করে মোবাইলে ছবি তোলা হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল কিন্তু ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। হাসপাতাল দিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। মরদেহ আনার জন্য আরও ১০ হাজার টাকা কীভাবে দিব। তার চিন্তায় শেষ। যাই হোক অনেক কষ্ট করে আসরের নামাজের ১৫-২০ মিনিট আগে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে এসে দাফন করা হয়। পরে অনেক কষ্ট করে টাকা পরিশোধ করেছি। বলে আবারও হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকেন।
ওই গ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এ বি এম এনামুল হক বকুল বলেন, বিপ্লবের পরিবার অসহায়। তার বাবা আগে ভ্যান চালাতেন। এখন অন্যের জমি ও বাড়িতে কাজ করে কোনো রকম সংসার চালান। যে ছেলে মারা গেছে তার আয় দিয়ে সংসার চলত তাঁর। ছেলে মারা যাওয়ার পর সেই আয় বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের জন্য সরকারের পক্ষে যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা ও শহীদ বিপ্লবের নয় বছরের শিশুর জন্য পড়ালেখার খরচ চালানোর দাবি তাঁর। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামির পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছে। এনামুল হক বকুল আরও বলেন, খুনি হাসিনাসহ দলের সবার বিচার হওয়া দরকার।
শহীদ বিপ্লব মণ্ডলের মা বিলকিস বেগম বলেন, আমার চার ছেলে-মেয়ে। এর মধ্যে বিপ্লব ২য়। সবার বড় মিমি, এরপর ফিরোজ আর সবার ছোট বৃষ্টি। বিপ্লবের জন্ম ১৯৯১ সালের ৮ জুলাই। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। অভাবের কারণে লেখাপড়া করেনি। বাড়ির পাশে মাদার মোল্লায় সেলুনের কাজ করত। তার উপার্জনের টাকা দিয়ে চলত সংসার। আজ থেকে ১০ বছর আগে একই গ্রামের আরিফার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ফুটফুটে একটা মেয়ে সন্তান আসে তার ঘরে। আস্তে আস্তে সংসারের অভাব বেড়ে যাওয়ায় সেলুনের কাজ করতে ঢাকায় যায় চার বছর আগে। সবাই থাকত। গত ৪ আগস্ট রাতে বিপ্লব ফোন দেয় তার বাবাকে। অল্প কথা বলে আমার সথে। বলল আব্বার বয়স অনেক হয়েছে। দেখে রেখে মা।
বিলকিস বেগম আরও বলেন, খুনি হাসিনা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। খুনি হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে আমরা সবাই ঘৃণা করি। কারণ এই দল শত শত মানুষকে গুলি করে শেষ করে দিছে। অনেকের মরদেহ গুম করে ফেলেছে। আমরা এই খুনি হাসিনার বিচারের দাবি করছি।
শহীদ বিপ্লবের স্ত্রী আরিফা বেগম বলেন, বাড়িতে বসে সময় না কাটাইয়া জুট মিলে চাকরি করছি। আমি ভোরে কাজে যাই আর সে সকাল ১০টায় দোকানে যায়। ঘটনার দিন আমার অফিস খোলা ছিল। আমি বাসায় থাকতেই বড় আপাকে ফোন দিয়ে বলে আপা আমার বাসায় আস, আমিনা (মেয়ে) একা থাকবে। সে প্রতিদিন দোকান বন্ধ রেখে আন্দোলনে যেত—এটা আমি পরে জানতে পেরেছি। তার বন্ধুরা দুপুরে বাসায় এসে বলে বিপ্লবকে গুলি করে মেরে ফেলেছে।
শহীদ বিপ্লবের স্ত্রী আরিফা বেগম আরও বলেন, আমার মেয়ে ছোট। সরকারের পক্ষ থেকে যদি আমার মেয়েকে লেখাপড়া করাতো। তাহলে অনেক ভালো হতো। মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।
শহীদ বিপ্লবের ৯ বছরের মেয়ে আমিনা বলে, বাবা সকালে দোকানে যাবার সময় বলেছিল আমার জন্য দুপুরে চকলেট নিয়ে আসবে। আর দুপুরে আমরা সবাই একসঙ্গে ভাতে খাব। বাবা আর ফিরে আসল না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি নওগাঁ সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অনার্স ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী রতন হাসান বলেন, ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাহিন সরকারসহ ২১ জন এসেছিলেন নওগাঁয়। তারা বিপ্লব ভাইয়ের কবর জিয়ারত করেছেন। আর নগদ কিছু অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। এদিকে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারন সম্পাদক সারজিস আলম রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমিতে এ চেক দেন।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জুলাই-আগস্টে নওগাঁর নয়জন শহীদ হয়েছেন।