লালমনিরহাটে বিলুপ্তির পথে মাথার টোপর শিল্প

হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে বা অন্নপ্রাশনের সাজের অন্যতম একটি সামগ্রী হলো টোপর। নতুন দম্পতির মাথায় উজ্জ্বল ও শৈল্পিক কারুকার্য খচিত শোলার তৈরি এই টোপর কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক গভীর প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কারুশিল্পের এই টোপর তৈরির পেছনে লুকিয়ে আছে অগণিত কারিগরের পরিশ্রমের গল্প, যা এখন বিলুপ্তির পথে।
টোপর তৈরির প্রধান উপাদান হলো শোলা, যা এক ধরনের জলজ উদ্ভিদ। শোলার কাঠ হালকা ও নমনীয় হওয়ায় এটি বিভিন্ন আকৃতিতে রূপ দেওয়া সম্ভব। প্রথমে শোলা সংগ্রহ করে কাঠামো তৈরি করা হয়, এরপর খোদাই ও নকশা করা হয়। তবে সব স্থানে এই উপাদান পাওয়া যায় না, ফলে কারিগরদের ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে শোলা কিনে আনতে হয়।
এমনও টোপর আছে যা তৈরিতে সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন। প্রতিটি টোপর হাতে তৈরিতে সূক্ষ্ম খোদাই ও নকশার জন্য কারিগরদের ধৈর্য ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের মৌসুমে টোপরের চাহিদা বেড়ে যায়। এ ছাড়া অন্নপ্রাশনসহ নানা আচার অনুষ্ঠানে এই টোপরের ব্যবহার রয়েছে। সাধারণ টোপর ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। তবে বিশেষ নকশার হলে দাম আরও বেশি হয়।
এক সময় লালমনিরহাট সদর উপজেলার পৌরসভার সাধুটারী এলাকায় বেশ কয়েকটি পরিবার এই টোপর তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে কষ্টার্জিত শ্রমের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় বেশিরবাগ পরিবারই এই পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে গেছে।
পৌরসভার সাধুটারী এলাকার দুই ভাই, শ্রী নিরুতপল মালাকার এবং শ্রী রামানুজ চন্দ্র মলাকার এ কারুশিল্প টিকিয়ে রেখেছেন। ছোট পরিসরে বাড়িতেই নামমাত্র কারখানা খুলে দীর্ঘদিন বাপ-চাচার পেশা ধরে রেখেছেন। তাঁরা জানান, একটি টোপর বানাতে আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর প্রয়োজন রয়েছে। যেমন, ফিতা, লেস, জরি, পুঁতি, আঠা, রং ইত্যাদি। প্রযুক্তির আধুনিকতায় ঐতিহ্যবাহী এই কারুশিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম কম মজুরির কারণে এই পেশায় আসতেই চায় না।

টোপর বানানো কারুশিল্পী শ্রী রামানুজ মালাকার বলেন, একজন কারিগর দিনে প্রকারভেদে দুই থেকে ছয়টি পর্যন্ত টোপর বানাতে পারে। তবে এমন টোপরও রয়েছে একটি বানাতে সারা দিন লেগে যায়। সেগুলোর দামও অনেক বেশি। টোপর ছাড়া বিয়ের সাজ অসম্পন্ন থাকে, তাই চাহিদা এখনও আছে। সরকারি সহায়তার অভাবে এক সময় হারিয়ে যাবে এই ঐতিহ্য।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ মতিয়ার রহমান বলেন, বিগত করোনাকালীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নামে একটি প্রকল্প ছিল, যা দ্বারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে এসব ঐতিহ্য ধরে রাখার বিষয়ে কাজ করত সমাজসেবা অধিদপ্তর। বর্তমানে আদি পেশায় নিয়োজিতদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। তবে নতুনভাবে প্রকল্প চালু হলে সংশ্লিষ্ট পেশার মানুষের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

টোপর একটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও কারুশিল্পের মেলবন্ধন। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে কারিগরদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা জরুরি বলে মনে করছেন খুচরা বাজারের ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।