সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি, মারামারি-কাটাকাটি করলে দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। 

মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর রাওয়া কনভেনশন হলে জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান এসব কথা বলেন।

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন যে আমি সতর্ক করিনি, আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজকে বলে দিলাম, নইলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি।

সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই, আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা, দেশ ও জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটি গ্রহণ করা। আই হ্যাড এনাফ লাস্ট সেভেন–এইট মান্থস, আই হ্যাড এনাফ। আমি চাই, দেশ ও জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব।’

দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আরেকটা জরুরি বিষয়, যেটা আমি ভাবলাম যে আপনাদের সঙ্গে আমি শেয়ার করি, দেশের এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের পেছনে কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণটা হচ্ছে যে আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা (অপরাধীরা) খুব ভালোভাবেই জানে যে, এই সময়ে যদি এসব অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব । সেই কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত থাকি, একত্রিত থাকি, তাহলে অবশ্যই এটা সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।’

পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই— এসব বাহিনী অতীতে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘(তারা) খারাপ কাজের সাথে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে। আজকে যে দেশের স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে, এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সেনা সদস্য, সিভিলিয়ান সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে অসামরিক–সামরিক সবাই মিলে, এই অর্গানাইজেশনগুলোকে ইফেক্টিভ রেখেছে, সেই জন্য আজকে সুন্দর, এতদিন ধরে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি।’

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘এদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) মধ্যে যদি অপরাধ করে থাকে, সেটার শাস্তি হবে। অবশ্যই শাস্তি হতে হবে। না হলে এই জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমন ভাবে কাজটা করব, এই সমস্ত অর্গানাইজেশনগুলো যেন আন্ডারমাইন্ড না হয়।’

পুলিশ বাহিনীকে এতোদিনে কার্যকর করতে না পারার পেছনের কারণ উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আজকে পুলিশ সদস্য কাজ করছে না। একটা বিশাল বড় কারণ হচ্ছে, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে জেলে। র‌্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই প্যানিকড (ভীতসন্ত্রস্ত)। বিভিন্ন দোষারোপ- গুম খুন ইত্যাদিতে। তদন্ত চলছে, অবশ্যই তদন্ত হবে, দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, এমন ভাবে কাজটা করতে হবে যেন এই অর্গানাইজেশনগুলো আন্ডারমাইন্ড না হয়। এই অর্গানাইজেশনগুলোকে যদি আন্ডারমাইন্ড করে আপনারা মনে করেন যে, দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজ করবে, সবাই শান্তিতে থাকবেন, এটা হবে না। সেটা সম্ভব না। আমি আপনাদের পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীর নয় সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘এই দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব খালি সেনা সেনাবাহিনীর না। দুই লাখ পুলিশ আছে, বিজিবি আছে, র‌্যাব আছে, আনসার–ভিডিপি আছে। আমার আছে হচ্ছে ৩০ হাজার সৈন্য। এটা দিয়ে আমরা দিন-রাত চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখানে যে সমস্ত উচ্ছৃঙ্খল কাজ হয়েছে সেটা আমাদের নিজস্ব তৈরি। এটা আমাদের নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচারড। আমরা এইগুলো তৈরি করেছি। এই বিপরীতমুখী কাজ করলে দেশে কখনো শান্তি শৃঙ্খলা আসবে না। এই জিনিসটা আপনাদের মনে রাখতে হবে।’

নির্বাচনের বিষয়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। তার আগে যে সমস্ত সংস্কার করা প্রয়োজন অবশ্যই সরকার সেদিকে হেল্প করবেন। আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি, কমপ্লিটলি অ্যাগ্রিড উইথ মি। দেয়ার শুড বি ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন অ্যান্ড দ্যাট ইলেকশন শুড বি উইথইন ডিসেম্বর, অর ক্লোজ টু দ্যাট। যেটা আমি প্রথমেই বলেছিলাম যে, ১৮ মাসের মধ্যে একটা ইলেকশন। আমার মনে হয় যে, সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এ দেশটাকে ইউনাইটেড রাখতে। ওনাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। উনি যেন সফল হতে পারেন। সেদিকে আমরা সবাই চেষ্টা করব। আমরা একসাথে ইনশাল্লাহ কাজ করে যাব।’

দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, আসুন, আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি না করি। দেশ জাতি যেন একসাথে থাকতে পারি সেদিকে আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের মধ্যে মতের বিরোধ থাকতে পারে। চিন্তা-চেতনার বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু দিন শেষে যেন আমরা সবাই দেশ এবং জাতির দিকে খেয়াল করে এক থাকতে পারি। তাহলে এই দেশটা উন্নত হবে। এই দেশটা সঠিক পথে পরিচালিত হবে। না হলে আমরা আরও সমস্যার মধ্যে পড়তে যাব।’

সামরিক বাহিনীর প্রতি অনেকে অকারণে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে উল্লেখ করে ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারো কারো। তবে কী কারণে আজ পর্যন্ত আমি আমি এটা খুঁজে পাইনি। আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স, যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে। আমাদেরকে আক্রমণ করেন না, আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেন, আমাদেরকে উপদেশ দেন। আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করব। আমরা একসাথে থাকতে চাই এবং দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’