মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে শেখ হাসিনাকে : স্কাই নিউজকে ড. ইউনূস

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। আজ বুধবার (৫ মার্চ) সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সরকার পরিচালনার সময় জোরপূর্বক গুম এবং গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে আন্দোলনকারীদের গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে।
স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘শুধু শেখ হাসিনা নন, যারা তার সঙ্গে জড়িত—তার পরিবার, ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ক্লায়েন্ট—তাদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’

বিরোধীদের দমন করতে শেখ হাসিনা একটি গোপন বন্দিশালার নেটওয়ার্ক (আয়নাঘর) পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেখানে আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এ সবই ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ বলে দাবি করা হতো।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা বর্তমানে সেই দেশটিতেই অবস্থান করছেন এবং তার বিরুদ্ধে দুটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে বাংলাদেশ সরকার।
ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তারি চিঠি পাঠিয়েছি, তবে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাইনি।’
তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে—তিনি বাংলাদেশে থাকুন বা না থাকুন। প্রয়োজনে তার অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে।
সম্প্রতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই বন্দিশালার (আয়নাঘর) একটি পরিদর্শন করেছেন, যার কোড-নাম ‘হাউস অব মিরর’। তিনি বলেন, ‘তিনি যা দেখেছেন তাতে তিনি হতবাক। এটি এমন এক বিভৎস স্থান, যা দেখলে শিউরে উঠতে হয়।’
তিনি আরও জানান, শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশের মাধ্যমে শত শত রাজনৈতিক কর্মীকে গুম, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ৮০০টি গোপন কারাগার পরিচালনার দায়ে অভিযুক্তদের অনেকেই এখনও আত্মগোপনে রয়েছেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অভিযোগগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সংখ্যা ও পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সময় লাগছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সরকারের সবাই এই কাজে জড়িত ছিল। কারা আদর্শগতভাবে সমর্থন করছিল, কারা আদেশ পালন করছিল, আর কারা অনিচ্ছাসত্ত্বেও অংশ নিয়েছিল—সেটা স্পষ্ট করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই-আগস্টে হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে শেখ হাসিনার প্রশাসন যেভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে অন্তত এক হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কত দ্রুত ন্যায়বিচার পাবে এবং তা তার তত্ত্বাবধানে ঘটবে কিনা—এই বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশাগুলো সামলাতে চেষ্টা করেছেন ড. ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, ‘কেউ শাস্তি পাবে, কেউ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকবে, আর কেউ হয়তো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে।’
শেখ হাসিনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তও শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক (শেখ হাসিনার ভাইঝি)-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চালাচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। তিনি বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রেখে গেছেন, যা এখন তদন্তের আওতায় এসেছে।’
তবে টিউলিপ সিদ্দিক অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তার মুখপাত্র জানিয়েছেন, ‘এ ধরনের কোনো বিষয়ে তার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা হয়নি।’
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলা
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অধ্যাপক ড. ইউনূস জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এখন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে, যাতে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়।
এদিকে, কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে অপরাধ, মাদক চোরাচালান এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘এই উত্তেজনা সহসা কমবে না।’