দুই লাখ নারীকে প্রশিক্ষণ, ১৬ হাজার কিশোরীকে সাইকেল দেবে সরকার

বিশ্ব জগতকে এগিয়ে নিতে নারী ও পুরুষের রয়েছে সমান ভূমিকা। কিন্তু বরাবরই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে নারীরা। এই পিছিয়েপড়া নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে নারীর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প শুরু করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য সাইকেল প্রদান, উপজেলা পর্যায়ে নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য প্রশিক্ষণ, পাটজাতপণ্য বৈচিত্র্যকরণের জন্য নারীদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান, গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ ও আইসিটিভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প।
নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোমধ্যে এই পাঁচ প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া গেলেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
জানা যায়, সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও তাদের কল্যাণে বদ্ধ পরিকর। তাই বৃহত্তর লিঙ্গ সমতার কৌশলের অংশ হিসেবে দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ওপর গুরুত্ব প্রদান এবং টেকসই উন্নয়ন ও নারী ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে, যা জাতীয় অগ্রাধিকার ও বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এসব প্রকল্প মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ও জাতীয় মহিলা সংস্থা বাস্তবায়ন করবে।
জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক সাহানা সারমিন বলেন, আমরা এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। তবে তৃণমূলে নারীদের স্বাবলম্বীসহ তাদের দক্ষ করে তুলতে নানা ধরনের ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
সূত্র মতে, প্রতিটি প্রকল্প বিশেষভাবে নারীদের সামনাসামনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, গ্রামাঞ্চল ও অবহেলিত অঞ্চলের নারীদের শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক গতিশীলতা অর্জনে প্রয়োজনীয় উপকরণ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য সাইকেল
‘কিশোরী ক্ষমতায়নে স্কুলগামী ছাত্রীদের সাইকেল প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি নিয়েছে সরকার। এর লক্ষ্য হচ্ছে ষষ্ঠ শ্রেণি ও এর পরবর্তী ক্লাসে পড়ুয়া স্কুলগামী কিশোরীদের স্কুলে যাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো। এই প্রকল্প আটটি জেলার ৫৯টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। জেলাগুলো হচ্ছে শরীয়তপুর, সাতক্ষীরা, পাবনা, হবিগঞ্জ, ভোলা, গাইবান্ধা, শেরপুর ও খাগড়াছড়ি।
প্রকল্পের মোট বাজেট ২৪ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান থাকবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং স্কুলে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ১৬ হাজার মেয়ে বাইসাইকেলে করে স্কুলে যেতে পারবে। এতে তাদের স্কুলে যাতায়াত সহজ হবে এবং এর মাধ্যমে ছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতা বৃদ্ধি পাবে। এতে নারীকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও উদ্যোগটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
উপজেলা পর্যায়ে আয়ের জন্য নারীদের প্রশিক্ষণ
উপজেলা পর্যায়ে মহিলাদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ (২য় পর্যায়)’ প্রকল্পটির লক্ষ্য ১৮-৪০ বছর বয়সী দুই লাখ ৮ হাজার ৩২০ নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। প্রকল্পের মোট বাজেট ৩৩৬ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের জানুয়ারি শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। প্রকল্পটি নারীদের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের আয় সৃষ্টির দক্ষতা বাড়াবে।
এ ছাড়া নারীকে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে সহিংসতা, শিশু বিবাহ এবং পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কেও সচেতন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
পাটপণ্য বৈচিত্র্যকরণের জন্য নারীদের উন্নত প্রশিক্ষণ
নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে পাটজাত পণ্য বহুমুখীকরণে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ’ প্রকল্পটি তিনি হাজার ৭৫০ নারী উদ্যোক্তা নিয়ে কাজ করবে। প্রকল্পটি ৩১ দশমিক ২৩ কোটি টাকায় বাস্তবায়িত হবে এবং এটি ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। এটি নারীদের পাটপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেবে। একই সঙ্গে তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব পাটপণ্য ব্যবহারের প্রচার ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে।
গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ
গ্রামকেন্দ্রিক নারীদের কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা হবে। এ প্রকল্পের মোট বাজেট ৪২৫ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটির আওতায় এক লাখ ৫০ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান উন্নয়নে কাজ করবে, যা দেশের বিভিন্ন জেলার ৯৩টি উপজেলায় পরিচালিত হবে।
মমতাজ আহমেদ বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় ছয় হাজার নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। প্রকল্পটি নারীদের জীবিকা উন্নয়ন ও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি গ্রামীণ অঞ্চলে লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে।
আইসিটিভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প
নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটির লক্ষ্য ২৫ হাজার নারীকে আইসিটি প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এই প্রকল্পের বাজেট ২৫৫ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা এবং এটি ২০২৫ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত চলবে। প্রকল্পটি নারীদের স্বনির্ভরতা ও মুক্ত পেশায় (ফ্রিল্যান্স) অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করবে, বিশেষত ফ্রিল্যান্সিংয়ে। এ ছাড়া সফল প্রশিক্ষণার্থীদের পাঁচ হাজার ল্যাপটপ ও দুই হাজার নারীর জন্য ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেওয়া হবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, এসব প্রকল্প গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন ও শহরের ওপর নির্ভরতা কমানোসহ বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করবে এবং নারীদের কর্মশক্তিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।