ভোটারবিহীন তিনটি নির্বাচনেই ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর মোরশেদ আলম

স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের দোসর ও ভোটবিহীন তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদ সদস্য হন বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম। রাজধানীর গুলশান-২ থেকে গতকাল মঙ্গলবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে আদালতে উপস্থাপনের কার্যক্রম চলছে।
আজ বুধবার (৯ এপ্রিল) ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার ও মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গণমাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নোয়াখালী-২ (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী উপজেলার একাংশ) আসন থেকে সংসদ সদস্য (এমপি) হন মোরশেদ আলম। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ এবং ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে সংসদ সদস্য হন তিনি।
নির্বাচন ছাড়াই এমপি
নোয়াখালীর (সেনবাগ-সোনাইমুড়ী) এ আসনটি ছিল বিএনপির দুর্গ। এ আসনটিতে ধারাবাহিকভাবে ১৯৯১ সালে পঞ্চম, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ, ১৯৯৬ সালে জুন মাসে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম ও ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির হয়ে পাঁচ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জয়নুল আবেদীন ফারুক।
কিন্তু ২০১৪ সালে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটবিহীন নির্বাচনে নোয়াখালী-২ (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী) আসন থেকে সংসদ সদস্য হন মোরশেদ আলম।
এর আগে নোয়াখালী-২ আসনে তিনি কোনো পরিচিত মুখ ছিলেন না, রাজনীতিতেও ছিলেন না। বরং ভোটবিহীন নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে এমপি হয়ে যান স্বৈরাচারের দোসর মোরশেদ আলম। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও অবাক হয়েছিলেন মোরশেদ আলমের এমন আত্মপ্রকাশে। কেননা দীর্ঘদিন ধরে সেনবাগে আওয়ামী লীগের পরিচিত মুখ ছিলেন ড. জামাল উদ্দিন ও কাজী জাফর। কিন্তু টাকার বিনিময়ে সেনবাগে এমপি হয়ে যান মোরশেদ আলম।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির এ নির্বাচন বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই বর্জন করে। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে অনেক বিতর্কের সৃস্টি হয়।
২০১৮ সালে রাতে ভোট চুরি করে এমপি
ভোটবিহীন নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ক্রমশ ক্ষমতা প্রয়োগ শুরু করেন মোরশেদ আলম। বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা করে পুলিশ বাহিনী দিয়ে বাড়িছাড়া করেন। ২০১৪ সালের পর বিএনপি–জামায়াতের কোনো নেতাকর্মী এলাকায় যেতে পারেনি মামলা-হামলা শিকার হয়ে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লিস্ট তৈরি করে মামলা দেওয়া শুরু করে মোরেশেদ বাহিনী। ক্যাডার বাহিনী তৈরি করে চালানো হয় নির্যাতন। বিরোধী মত দমন করে ধারাবাহিকভাবে ২০১৮ সালেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করে এমপি হয়ে যান মোরশেদ আলম।
২০২৪ সালের নিজের লোক দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আবারও এমপি
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে শেখ হাসিনার দোসর হিসেবে আবারও নোয়াখালী-২ (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী) আসন থেকে সংসদ সদস্য হন মোরশেদ আলম। এ নির্বাচনেও বিএনপি–জামায়াতসহ বিরোধী কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। বরং শেখ হাসিনার নির্দেশে দলীয় অপর প্রার্থী আতাউর রহমান মানিক ওরফে তমা মানিকের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এমপি হয়ে যান মোরশেদ আলম। আতাউর রহমান মানিক জোরপূর্বক ভোট কারচুপি করে এমপি হওয়ার অভিযোগ আনেন মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে।
মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ফ্যাসিজমকে টিকিয়ে রাখতে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেন কিছু ব্যবসায়ী নামধারী অলিগার্ক। শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়ে তারা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়েছেন। তার ত্রাণ তহবিলে শত শত কোটি টাকা ‘দান’ করে ‘ভালো মানুষী’ কুড়িয়েছেন। বিপরীতে তারা হাসিনার সঙ্গে সম্পর্কের বরাত দিয়ে ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লুটে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। এমনই এক অলিগার্ক মোরশেদ আলম।
ব্যবসায়ী থেকে হাসিনার কল্যাণে ‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে যান মোরশেদ আলম। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের আগে তিনি শেখ হাসিনার ‘টিনের বাক্সে’ দান করেন একশ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগের ডোনার মোরশেদ আলম ছোট ভাই মোহাম্মদ জসিমউদ্দিনকে বিনা নির্বাচনে বসান এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট পদে। এভাবে তিনি ব্যবসায়ী কমিউনিটিতে প্রতিষ্ঠা করেন আধিপত্য।
বেঙ্গল গ্রুপের মালিক মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে রয়েছে টেলিভিশন দখল, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি দখল, জায়গা-জমি দখল, বেনামি প্রতিষ্ঠান খুলে সেটিকে ‘শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ’ দেখিয়ে নানামাত্রিক সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, আমদানি-রফতানির নামে অর্থ পাচার, শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিয়ে প্লাস্টিক দানা (রেজিন) আমদানি করে চোরাই বাজারে বিক্রি, জাল-জালিয়াতি, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে টানা ১১ বছর কব্জায় রেখে ইচ্ছেমতো লুটপাট, প্রতিষ্ঠানের বোর্ড সদস্যদের কোণঠাসা করতে দুদককে দিয়ে মামলা, পর্যাপ্ত শেয়ার থাকা সত্ত্বেও বোর্ডে ঢুকতে না দেওয়া, একই সঙ্গে একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও চেয়ারম্যান পদ কব্জায় রাখাসহ বহুমাত্রিক অপরাধের অভিযোগ।