কুকুরের প্রতি রনির অন্যরকম ভালোবাসা

‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ স্বামী বিবেকানন্দের এই অমর বাণীটি যেন সত্যি হয়েছে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার ঘাঘর বাজারের মোবাইলফোন মেকানিক জি এম রনির ক্ষেত্রে। প্রায় ৫ বছর ধরে বাজারে থাকা ২৫ থেকে ৩০টি কুকুরকে প্রতিদিন ৩ বেলা খাবার দিয়ে ভালোবাসার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
রনি উপজেলার দক্ষিণ কয়খা গ্রামের আবুল হোসেন গাজীর ছেলে। তিনি স্থানীয় ঘাঘর বাজারে প্রায় ৭ বছর ধরে মোবাইলফোন মেকানিকের কাজ করে আসছেন। ছেলেবেলা থেকেই পশুপাখির প্রতি রনির ছিল অন্যরকম ভালবাসা। সেই ভালবাসা থেকেই তার চলার পথে সামনে কখনো কুকুর-বিড়াল পড়লে তাদেরকে খাবার কিনে খাওয়াতেন।
করোনাকালীন সময়ে লকডাউনে ঘাঘর বাজারের দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেলে খাদ্যের অভাবে বিপাকে পড়ে যায় বাজারে থাকা কুকুরগুলো। এসময় ভালোবাসার টানে কুকুরগুলোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন রনি। লকডাউনে যখন প্রশাসনের চাপ ও মৃত্যুভয়ে মানুষ ঘরবন্দি তখন নিজ বাড়ি থেকে রান্না করে ঘাঘর বাজারে থাকা কুকুরগুলোর জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে আসেন রনি। প্রথমে ৫ থেকে ৭টি কুকুর থাকলেও ক্রমেই এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে ২৫ থেকে ৩০ কুকুরকে ৩ বেলা খাবারের ব্যবস্থা করছেন রনি। তাঁর এই খাবারের তালিকায় রয়েছে দুধ মাখানো ভাত, পাউরুটি ও বিস্কুট। তবে বাড়িতে যেদিন মাংস রান্না হয় সেদিন কুকুরের জন্য রান্না করা মাংস আনতে ভুলেন না জি এম রনি।
শুধু যে কুকুরগুলোকে ৩ বেলা খাবার দেন তাহাই নয়। কোন একটি কুকুর অসুস্থ হলে বা কেউ আঘাত করলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন রনি। নিজ হাতে ওষুধও খাইয়ে দেন অসুস্থ কুকুরগুলোকে। কোন কুকুরের গায়ে ক্ষত বা ঘাঁ হলে নিজ হাতে তা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দেন।
প্রথম দিক দিয়ে জি এম রনির আশপাশের ব্যবসায়ীরা ও পরিবারের লোকজন তাঁর এই কাজে বিরাগভাজন হলেও এখন সবাই প্রশংসা করছেন। এই কুকুরগুলোর জন্য নিয়মিত ৩ বেলা ভাত রান্না করতে রনিকে সহযোগিতা করছেন তার স্ত্রী। শুধু স্ত্রীই নয়, মা-বাবা ও তার বন্ধুরাও নিয়মিত সহযোগিতা করছেন বলে জানিয়েছেন এই প্রাণিপ্রেমী জি এম রনি।
জি এম রনি বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই পোষা প্রাণীদের খুব ভালবাসি। সেই ভালবাসা থেকেই করোনাকালীন সময়ে ঘাঘর বাজারে খাদ্যসংকটে থাকা কুকুরগুলোকে ৩ বেলা খাবার খাওয়ানো শুরু করি। যা আজও চলমান রেখেছি। এখন এসব কুকুরের প্রতি অন্যরকম ভালবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এই কুকুরগুলোর প্রতি আমার ভালবাসা এ পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে যে, আমি এখন কোথাও বেড়াতে যেতে পারি না। বেড়াতে গেলে ওদেরকে কে খাওয়াবে? সবসময় এই ভাবনায় থাকি। কুকুরের প্রতি আমার এই ভালবাসা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তবে কুকুরের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে এভাবে খাওয়ানোর যে কার্যক্রম তা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কতদিন ধরে রাখতে পারব সেটি এখন চিন্তার বিষয়।

ব্যবসায়ী উজ্জ্বল সাহা বলেন, রনি আমার দোকানে ৬/৭ বছর ধরে মোবাইলফোন সার্ভিসিংয়ের কাজ করে। সে করোনার সময় থেকে ঘাঘর বাজারে থাকা কুকুরগুলোকে খাবার দিয়ে আসছে। প্রথম দিকে তার এই কাজ নিয়ে উপহাস করলেও পরে বুঝতে পারি সে যা করছে তা অত্যন্ত মানবিক। এখন আমরা তাকে এই কাজে উৎসাহ দিচ্ছি।
চায়ের দোকানদার আক্কেল আলী বলেন, রনি ভাই প্রতিদিন বাড়ি থেকে ভাত এনে আমার দোকান থেকে দুধ কিনে সেই ভাত দুধ দিয়ে মেখে কুকুরকে খাওয়ায়। কোনদিন ব্যস্ততার কারণে ভাত না আনতে পারলে আমার দোকান থেকে রুটি ও বিস্কুট কিনে কুকুরকে খেতে দেয়।
কবি ও কলেজ শিক্ষক মিন্টু রায় বলেন, রনি যে কাজটি করছে তা অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। রনির মতো আমরা যদি সকলে এভাবে প্রাণীকে ভালো বাসতাম তাহলে পৃথিবীটি খুব সুন্দর হতো। আমাদের উচিত রনির মতো যারা প্রাণী ভালোবাসে তাদের পাশে দাঁড়ানো।