মেধা পাচার : তরুণদের জীবনের লক্ষ্যই যখন দেশত্যাগ

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, উন্নত জীবন ও উচ্চশিক্ষার আশায় গত দেড় দশকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের দেশত্যাগের পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে দেশত্যাগ।
বিশ্বব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, বিগত এক দশকে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশে হিমশিম খান স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা শিক্ষার্থীরা। এতে করে তাদের মধ্যে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
রাজধানীর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আয়াজ বিন ফারুক। স্নাতক শেষ করতে আয়াজের বাকি দুই সেমিস্টার। কিন্তু স্নাতক শেষ করে কোন চাকরি করবেন—এ ব্যাপারে এখনও কোনোকিছু ঠিক করতে পারছেন না তিনি।
নিজের হতাশার কথা জানিয়ে আয়াজ বলেন, বাংলাদেশের ছাত্রদের হাতে মূলত তিনটি অপশন। পাস করে হয় বিসিএসের জন্য পড়াশোনা, না হলে ব্যাংক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, আইএলটিএস দিয়ে বিদেশ যাওয়া।
বাংলাদেশে নবম গ্রেডের প্রথম শ্রেণির চাকরি হিসেবে বিসিএস বিবেচ্য। চাকরির নিশ্চয়তা ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় অনেক শিক্ষার্থী বিসিএসকে রাখেন পছন্দের তালিকার শীর্ষে। কিন্তু পদের হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিবছর যতজন এই পরীক্ষার জন্য আবেদন করেন, তার তুলনায় মোট পদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসে মোট ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০৮ জন আবেদন করেছেন, যেখানে শূন্য পদের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ১৪০।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী সফিউর রহমান বলেন, সকাল থেকে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে সবাই লাইন ধরে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে যায়। প্রথম বর্ষ থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে, এমনও অনেকে আছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএস সোনার হরিণ, যার পেছনে না দৌড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত বড়সংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছে।
শুধু বিসিএস নয়, সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও অনেক শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন বিদেশকে। সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে পড়াশোনার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডন পাড়ি জমিয়েছেন ফাতেহা জাহান ইকু।
ফাতেহা জাহান ইকু বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনও দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার পায় না। দেশের সামাজিক অবস্থাও নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে প্রস্তুত না। এক্ষেত্রে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত মেয়েদের বেশিরভাগরই পছন্দ বিদেশ পাড়ি জমানো।
মূলত বিদেশে নারীর নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যই দেশের নারী শিক্ষার্থীদের কাছে মুখ্য বলে জানান ইকু।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাবে, প্রতিবছর ১০ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করে। এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো চাকরির বাজার কিংবা সুষ্ঠু পরিকল্পনা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম। রিভার্স ব্রেইন বিডি এবং মেধা পাচার রোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যমান চাকরির সঙ্গে প্রতি বছর পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীর অনুপাত বিবেচনা করলেই বোঝা যায়, কেন বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী দেশ ছাড়তে চায়।
তার মতে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশের ভেতরে চাকরি পাচ্ছে না। যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে গেছেন তারা দেখছেন, ফিরে এলে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে—এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। যারা দেশে আছেন, তাদের অবস্থা দেখে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু পরিকল্পনার বড় অভাবের কারণে চাইলেই রিভার্স ব্রেইন বিডি ক্যাম্পেইন বাস্তবায়ন সম্ভব না বলে মনে করেন এ শিক্ষক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশ স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর পাস। যাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের মধ্যে বরং বেকারত্বের হার কম। অর্থাৎ যারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন তাদের জন্য দেশে সন্তোষজনক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না বলেই স্পষ্ট করছে পরিসংখ্যান।
অন্যদিকে দেশে যারা চাকরি করছেন তারা নিজেদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে খুশি নন। এছাড়া দেশের অফিস সংস্কৃতি নিয়েও মনঃক্ষুণ্ন তরুণরা। এমনই এক করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ফয়সাল রিমন বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন নতুন নতুন ওয়ার্ক কালচার প্রবর্তন হচ্ছে, সেখানে এখনও মান্ধাতার আমলের নিয়মে চলছে বাংলাদেশ। দেশের বেশিরভাগ অফিসে শ্রম আইনের ধার ধারা হয় না। নিজেদের কাঠামো অনুযায়ী বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ঠিক করে কোম্পানিগুলো।
একটা সময় ছিল তরুণরা চাকরিক্ষেত্রে তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন ছিল না। বেতন-ভাতার ব্যাপারে ছিল না সম্যক ধারণা। কিন্তু বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তরুণ চাকরিজীবীরা নিজেদের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ পাচ্ছে, পারছে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে। সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে–অভিমত রিমনের।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের ছাত্র শাফায়াত আল রাজি বলেন, বাংলাদেশে একজন শিক্ষার্থীর চাকরি জীবন শুরু হতে হতে বয়স ২৫ পেরিয়ে যায়। এরপর অনেকের ২-৫ বছর শুধু চাকরির জন্য প্রস্তুতিই নিতে হয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে ১৬-১৮ বছরের মধ্যে একটি ছেলে চাকরিতে প্রবেশ করে এবং আয় করতে শুরু করে।
নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে শাফায়াত বলেন, ‘বাংলাদেশে থাকতে আমার পড়াশোনার খরচ আমার মা-বাবাকে দিতে হতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর পড়াশোনার পাশাপাশি আমি পার্ট টাইম চাকরি করতে পারছি। আমার বার্ষিক বেতন গড়ে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডলার। নিজের খরচ চালিয়ে দেশেও টাকা পাঠাতে পারছি। এটি বাংলাদেশে থাকলে সম্ভব হতো না।’
ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫২ হাজার ৮০০ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে। দেড় দশক আগে ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল মোটে ১৬ হাজার ৮০৯।
ইন্ট্যারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জের ওপেন ডোর রিপোর্ট-২০২৪ অনুযায়ী, গত বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৭ হাজার শিক্ষার্থী পাড়ি জমিয়েছে, যা যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরের তুলনায় এ সংখ্যা ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বেশি।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ফেলো গবেষক নুসরাত জাহান চৌধুরী বলেন, গত কয়েক বছর ধরে প্রচুর বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে আসছে, যাদের বড় সংখ্যকই আর দেশে ফিরবেন না। অনেকগুলো কারণের মধ্যে জীবনযাত্রার মান বা সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বাইরেও একটি বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে বিদেশের উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান আর দক্ষতার মূল্যায়নের অভাব আছে, পাশাপাশি নেই পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ।
নুসরাত জাহান চৌধুরী বলেন, অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে, উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরত গেলেও তাকে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয় না, যার জন্য তার নতুন দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। উচ্চশিক্ষা অর্জনের পরে দেশে ফিরে পূর্বের প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলে নতুন দক্ষতা অনুযায়ী তাকে উপযুক্ত পারিতোষিক না দেওয়ার নজিরও বহু আছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের ওয়ার্ক কালচার অনুযায়ী, একই প্রতিষ্ঠানে বেশিদিন ধরে কর্মরত ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে প্রমোশন বা আপগ্রেডেশনে এগিয়ে থাকেন। সেখানে দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার থেকেও মূখ্য হয়ে ওঠে কর্মরত ব্যক্তির বয়স। কখনও কখনও প্রতিষ্ঠান বা দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে হয় চাকরিজীবীদের, যেটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে হরহামেশা দেখা যায়। এছাড়া স্বাধীনভাবে গবেষণা বা মত প্রকাশ করার ফলে নানারকম হয়রানিতেও পড়তে হয়, যদি তা ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।
এসব বিবেচনায় বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে অনেক শিক্ষার্থী দেশে ফেরা সমীচীন মনে করেন না বলে জানান এই গবেষক।
জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড করপোরেশনের (ডি+সি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বহু বছর ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ওপর ভরসা করে আসছে। এতে করে ১৯৮০ সালের দিক থেকে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোয় বাংলাদেশের সরকারের আগ্রহ ছিল সর্বাগ্রে। কিন্তু বর্তমান অভিবাসন প্রক্রিয়া আলাদা। এখন যারা দেশ ছাড়ছেন তাদের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং পশ্চিমে। যারা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন তারা একসময় দেশে ফিরে এসেছেন। এখন যারা উন্নত জীবনের আশায় পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাদের ফিরে আসার মনোভাব নেই।
যারা ফিরে না আসার সংকল্প নিয়েই দেশ ছাড়ছেন তাদের ব্যাপারে ভাবতে হবে, তাদের দেশে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। রেমিট্যান্সকে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড না বানিয়ে মেধার ওপর গুরুত্বারোপ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে মেধার সর্বোচ্চ উপযোগিতা আদায়ের প্রস্তাব দেওয়া হয় প্রতিবেদনে।