উপরে মেট্রোবিলাস, নিচে বিশৃঙ্খলা

ঢাকার মেট্রোরেল চালুর সময় এটিকে আধুনিক ও সুশৃঙ্খল শহরের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছিল। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আরামদায়ক ট্রেনযাত্রা রাজধানী ঢাকার অগ্রগতি নিয়ে আশার সঞ্চার করেছিল। তবে উপরে ঝাঁ চকচকে লাইন থাকলেও তার নিচে ফুটে উঠেছে উল্টো চিত্র।
মেট্রোরেল লাইনের নিচের ফাঁকা জায়গাগুলো সবুজায়ন ও জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ছিল। এ লক্ষ্যে কিছু গাছপালাও লাগানো হয়েছিল। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সেগুলোর বেশিরভাগেরই আর অস্তিত্ব নেই। গাছের চারাগুলো উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং চলাচলের পথ দখল করেছেন শহরের গৃহহীন মানুষেরা। রোদ-বৃষ্টিতে মেট্রোরেলের নিচের স্থানগুলো এখন তাদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ উদ্বোধনের পর থেকে ধাপে ধাপে এই মেট্রোরেল পরিষেবা মতিঝিল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু যে স্থানগুলো একসময় পথচারী ও জনসাধারণের জন্য পরিষ্কার ও উন্মুক্ত থাকার কথা ছিল, সেগুলো এখন দখল হয়ে গেছে। ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার, কাজীপাড়া থেকে মিরপুর—সব জায়গাতেই এখন হকার ও ভিক্ষুকদের দৌরাত্ম্য।
ফুটপাতে অস্থায়ী দোকান, পথশিশু ও আবর্জনার স্তূপের ভিড়ে যাত্রীদের চলাচল করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
‘নিচের অংশ দেখলে মনে হয়, মেট্রোরেল যেন বস্তির ওপর তৈরি করা হয়েছে।’ ফার্মগেট এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তানভীর হাসান বিষয়টিকে এভাবেই বর্ণনা করেন। বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম মেট্রোর কারণে শহরের চেহারা বদলে যাবে। কিন্তু পরে দেখছি, সমস্যাগুলো আছেই, শুধু নতুন জায়গায় সেগুলো সরে এসেছে।’
মেট্রোরেল ও এই রেললাইন-সংলগ্ন সড়কগুলোতে নিয়মিত চলাচলকারীদের ভাষ্য, ‘দৃশ্যপটটি দুশ্চিন্তার। মেট্রোরেল লাইনের নিচে ছাউনির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিকের পলিথিন, মাটিতে পড়ে আছে পুরোনো তোশক, আর পায়ে হাঁটার পথের কাছেই ভাজা খাবার রান্না করছেন বিক্রেতারা। স্টেশন গেটের পাশে বসে থাকা ভিক্ষুকরা পথচারীদের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ এমন পরিবেশ শুরুতে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।’
মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশন থেকে পোশাককর্মী আসমা খাতুন বলেন, ‘প্রতিদিন বিকেলে এই জায়গা একেকটা ছোট বাজারে রূপ নেয়। শব্দ, ভিড় আর ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে চারদিক। এখানে একা একা হাঁটাও অনেকসময় নিরাপদ মনে হয় না।’
শুরুতে কিন্তু পরিবেশ এমন ছিল না। তবে দায়িত্বশীলদের সঠিক তদারকির অভাবে ধীরে ধীরে এমন শ্রীহীন হয়ে উঠেছে মেট্রোরেলের নিচের জায়গাগুলো। প্রথমে একজন হকার এসেছেন, তারপর তার দেখাদেখি অন্যরা। এরপর গৃহহীনরা একেক করে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। এভাবে এখন জায়গাগুলোর সবটুকু একপ্রকার বাজারের চেহারা নিয়েছে।
এই জায়গাগুলো দখলমুক্ত করতে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে কর্তৃপক্ষের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ফলে যে ব্যবস্থাকে নগর পরিবহনের বিপ্লব বলা হচ্ছিল, তা এখন পুরোনো বিশৃঙ্খলার আরেকটি রূপে পরিণত হচ্ছে।
প্রতিদিন মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন বেসরকারি চাকরিজীবী মাহবুব আলম। তিনি বলেন, ‘এটা হওয়ার কথা ছিল পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক ঢাকা। কিন্তু এখন প্রতিটি স্টেশনের নিচে দেখি সেই পুরোনো বিশৃঙ্খলাই, যা থেকে আমরা পালাতে চেয়েছিলাম।’
এর ফলে কারওয়ান বাজার মেট্রো স্টেশনের আশপাশের দোকানিরাও পড়েছেন বিপাকে। সেখানকার একটি মুদি দোকানের মালিক রিনা আক্তার বলছিলেন, ফুটপাত জুড়ে হকাররা বসে আছে, আবার চারপাশ নোংরাও হয়ে যাচ্ছে। এতে ক্রেতাদের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
এই সমস্যার নেপথ্যে নির্মাণ-পরবর্তী পরিকল্পনা-ঘাটতিকেই দায়ী করেছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী ড. শফিক রহমান বলেন, যদি আগে থেকেই এই জায়গাগুলোর ব্যবহার নির্ধারিত থাকত, যেমন: হাঁটার পথ, সবুজ এলাকা কিংবা ছোট পার্ক—তাহলে এমনটা হতো না।
এই খোলা জায়গাগুলো মূলত জনসাধারণের উপকারের জন্যই পরিকল্পনায় ছিল। তবে বাস্তবে কোনোকিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানগুলো রয়ে গেছে অনিয়ন্ত্রিত, ফলে হকার ও গৃহহীনরা অবাধে তা দখলে নিয়েছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এখন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনো নির্দিষ্ট কৌশল ঘোষণা করেনি।
এখন নগরবাসী প্রতিদিন একই সঙ্গে দুটো বিপরীত চিত্রের মুখোমুখি—উপরে আধুনিকতার ঝলক, আর নিচে পুরোনো বিশৃঙ্খলার ছায়া।