দুর্যোগে নয়, প্রতিরোধে জিততে চায় উপকূল

‘সমন্বিত উদ্যোগ, প্রতিরোধ করি দুর্যোগ’— এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ সোমবার (১৩ অক্টোবর) সারা দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস।
দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট থেকে শুরু করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুর— বাংলাদেশের প্রায় ৭২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলজুড়ে দুর্যোগের হুমকি এখন নিত্যসঙ্গী। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততা ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে।
দেশের উপকূল অঞ্চলে প্রায় তিন কোটি মানুষ বাস করে, যাদের অধিকাংশই জলবায়ুজনিত দুর্যোগের ঝুঁকিতে। সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল, আম্পান কিংবা মোখার মতো ঘূর্ণিঝড়ে বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে উপকূলের গ্রামীণ অর্থনীতি। অনেক এলাকায় এখনো লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে, মিষ্টি পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে।
খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বরগুনার পাথরঘাটা, পটুয়াখালীর গলাচিপা বা কক্সবাজারের টেকনাফ— সর্বত্র একই চিত্র; মানুষ প্রতিনিয়ত লড়ছে প্রকৃতির সঙ্গে, টিকে থাকার জন্য।
শ্যামনগরের কৃষক আব্দুল হাকিম বলেন, “আমরা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ভয় নিয়ে বেঁচে আছি। নদীর পানি উঠলে ঘরভিটা ভেসে যায়। টেকসই বেড়িবাঁধ আর আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
গত এক দশকে উপকূলীয় এলাকায় বহু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখনো অনেক ইউনিয়নে আশ্রয়কেন্দ্র দূরে বা অপর্যাপ্ত। দুর্যোগকালীন সময়ে নিরাপদে স্থানান্তর, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, নারী ও শিশুদের সুরক্ষা— এসব ক্ষেত্রেও ঘাটতি রয়ে গেছে।
দুর্যোগকালীন সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া, স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ এবং জরুরি সরঞ্জাম সংরক্ষণেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের তরুণ ড. মনিরুজ্জামান বলেন, “দুর্যোগের সময় শুধু সরকারি প্রশাসন নয়, স্থানীয় জনগণ, এনজিও ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই প্রকৃত দুর্যোগ প্রতিরোধ সম্ভব।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উপকূলীয় এলাকায় টেকসই নদী বাঁধ, জোয়ার-ভাটার সঠিক প্রবাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, মিষ্টি পানির সংরক্ষণ এবং বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষে বহু খাল ও জলাধার ভরাট হয়ে যাওয়ায় নিষ্কাশন ব্যবস্থার ভঙ্গুরতায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত সহ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের পানি নামতে না পেরে গ্রাম ডুবে যাচ্ছে, বেড়িবাঁধ বারবার ভেঙে পড়ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।
সমাজকর্মী অ্যাডভোকেট জাফরুল্লাহ ইব্রাহিম বলেন, “প্রতিনিয়ত বেড়িবাঁধ ভাঙছে, খাল দখল হয়ে যাচ্ছে। সমন্বিত পরিকল্পনা ও জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া উপকূল টিকবে না।”
দুর্যোগ প্রশমনে শুধু অবকাঠামো নয়, সচেতন জনগণই হতে পারে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধশক্তি।
ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় সঠিক সতর্কবার্তা অনুসরণ, পরিবার ও গ্রামভিত্তিক প্রস্তুতি দল গঠন, বৃক্ষরোপণ, খাল-নদী দখলমুক্ত রাখা এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা— এসব উদ্যোগে কমানো সম্ভব প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি।
সরকারি মহাসিন কলেজের সহকারী অধ্যাপক সিদ্দিকুল ইসলাম বকুল বলেন, “আমরা যদি আগে থেকেই প্রস্তুত থাকি, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো যায়। আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিতে হবে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে প্রশংসিত হলেও, প্রকল্পভিত্তিক উদ্যোগের বাইরে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থানীয়ভাবে অভিযোজনযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
দুর্যোগ এড়ানো সম্ভব নয়— কিন্তু সময়োপযোগী প্রস্তুতি, স্থানীয় সম্পৃক্ততা ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে, প্রাণ বাঁচাতে পারে। কারণ, উপকূলের মানুষ দুর্যোগে নয়, প্রতিরোধেই জিততে চায়। সঠিক পরিকল্পনা, জনগণের অংশগ্রহণ আর সমন্বিত উদ্যোগই পারে বাংলাদেশের উপকূলকে টেকসই সুরক্ষার পথে এগিয়ে নিতে।