পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাঠকর্মীদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের (আগের একটি বাড়ি একটি খামার) গ্রাহকদের নামে ‘ভূতুড়ে ঋণ’ দেখিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে এই প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় প্রায় আট হাজার ৫৮২ জন সদস্য রয়েছেন এবং প্রায় ১২ কোটি টাকার সরকারি ঋণ চলমান আছে। অভিযোগের তীর মূলত এই প্রকল্পের মাঠ-সহকারীদের বিরুদ্ধে, যারা গ্রাহকদের পাস বই নিজেদের কাছে রেখে ভুয়া ঋণ দেখিয়ে অর্থ লুটপাট করছেন বলে ভুক্তভোগীরা জানান।
আজ বুধবার (১৫ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সামনে এই ভুক্তভোগী সদস্যরা উপস্থিত হলে সাংবাদিকদের কাছে তারা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন।
মাঠ সহকারীদের কার্যপ্রণালী নিয়ে ভুক্তভোগীরা জানান, মাঠ সহকারীরা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের গ্রাহকদের পাস বই নিজেদের কাছে সংরক্ষিত রাখেন। গ্রাহকদের থেকে ঋণ ও সঞ্চয়ের টাকা উত্তোলনের সময় তারা সাদা একটা কাগজে লিখে দিয়ে আসেন, যা হারিয়ে গেলে ঋণ ও সঞ্চয়ের টাকার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
পাকুরিয়া গ্রামের হাফিজ বর্তমান ম্যানেজারের ফোনে অফিসে এসে জানতে পারেন, তার পরিশোধিত ঋণের মাত্র চার হাজার টাকার ডকুমেন্ট আছে। হাফিজ জানান, তিনি শেষবারে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে চার হাজার টাকা করে ৬টি কিস্তি (মোট ২৪ হাজার টাকা) দিলেও অফিসে মাত্র চার হাজার টাকা জমা দেখানো হয়েছে। তার এলাকার মাঠকর্মী গৌতম মন্ডলের বিরুদ্ধে ১৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে এবং তিনি শাস্তি স্বরূপ জেলা অফিসে বদলি হলেও সেখানে যোগদান করেননি।
ষাটোর্ধ্ব অঞ্জলী ব্যানার্জী বলেন, অফিস তার কাছে মাত্র তিন হাজার টাকা পেত, অথচ দুই দিন আগে এক কর্মকর্তা তাকে জানান, তার নামে ২০ হাজার টাকার কিস্তি বকেয়া আছে। তার বইও তারা নিয়ে এসেছেন। ঋণ পরিশোধ হওয়া সত্ত্বেও ২০ হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আসা মুক্তা ব্যানার্জী নামের এক গৃহবধূ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ঋণ নিতে তার ও স্বামীর স্বাক্ষর প্রয়োজন হলেও তারা স্বাক্ষর দেননি। পুষ্পা দাশ ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কয়েকটি কিস্তি দিলেও অফিস এখনও তার কাছে পুরো ২০ হাজার টাকাই দাবি করছে।
একইভাবে দিপালী দাশ এক হাজার ৬০০ টাকা সঞ্চয় জমা দিয়ে কয়েকদিন আগে জানতে পারেন যে তার নামে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। মাঠকর্মী শামছুল হক ঋণ দেওয়ার কথা বলে এক হাজার ৬০০ টাকা সঞ্চয় নিয়ে পাঁচ থেকে সাত দিন অফিসে ঘুরিয়েছেন, কিন্তু ঋণ তো দূরের কথা, সঞ্চয়ই ফেরত দেননি। রীনা বেপারী জানান, তিনি সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে দুই মাস শামছুর পিছনে ঘুরেছেন। অফিসে এনে স্বাক্ষর রেখে দিয়ে সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও গত পরশু জানতে পারেন তার নামে ১০ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া সাজ্জাদ ও রাজীব মন্ডল নামের দুজন গ্রাহক অভিযোগ করেন, তাদের ঋণ পরিশোধ হওয়া বই থাকা সত্ত্বেও মাঠকর্মীরা নতুন করে কিস্তি নেওয়ার জন্য বাড়িতে যাচ্ছেন ও ফোন দিচ্ছেন।
ভুক্তভোগীরা আরও অভিযোগ করেন, মাঠকর্মীরা তাদের সঙ্গে সব সময় খারাপ আচরণ করেন। তারা স্থানীয় এবং দীর্ঘদিন ধরে উপজেলায় চাকরি করায় কেউ তাদের প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। তারা সবসময় পাস বই ছাড়াই কিস্তি ও সঞ্চয়ের টাকা উত্তোলন করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত মাঠ-সহকারী সামছুল হক ও গৌতম মন্ডলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে, সামছুল হকের শাস্তিজনিত বদলি হওয়ার পর তার জায়গায় আসা পংকজ কুমার রায় জানান, তিনি মাঠে জানতে পেরেছেন যে সামছুল হকের বিরুদ্ধে সদস্যদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া ও সদস্যদের নাম দিয়ে ঋণ নেওয়ার নানা অভিযোগ রয়েছে। পাস বইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, প্রায় একশর মতো বই তার কাছে আছে, যা অডিট করার জন্য রেখেছিলেন। এক মাস অডিট শেষ হলেও বই জমা দিচ্ছেন না কেন—এমন প্রশ্নে তিনি অফিস থেকে বের হয়ে যান।
নাজিরপুর উপজেলা শাখা ব্যবস্থাপক মো. মহিউদ্দিন বলেন, এই লোনগুলোর সময়ে আমি এখানে কর্মরত ছিলাম না। কয়েকজন গ্রাহক আজ অফিসে এসেছেন, তাদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু করা হবে। তিনি আশ্বাস দেন, কোনো গ্রাহক লিখিত অভিযোগ দিলে তা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।