‘অন্যের সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের সন্তান অমানুষ হয়ে যাচ্ছে’

‘অন্যের ছেলে-মেয়েদের পড়াই, মানুষ বানাই। কিন্তু নিজেদের ছেলে-মেয়েদের মানুষ বানানোর সুযোগ পাই না, পড়াতে পারি না, খরচ চালাতে পারি না। তারা তো অমানুষ হয়ে যায়’— আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালীর সদর উপজেলার করমুল্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নুরুল হক।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত চারদিন তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। হোটেলে থাকা, নিয়মিত আন্দোলনে যোগ দেওয়া তার জন্য খুবই কষ্টকর বলেও জানান।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজ শনিবার (১৮ অক্টোবর) এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে নুরুল হক বলেন, চারদিন ধরে আমরা আমাদের স্কুলের তিনজন শিক্ষক এখানে রয়েছি। বাকি তিনজন আগে ছিলেন। আগামীকাল আরও তিনজন আসবেন, তখন আমরা চলে যাবে। এখানে বোর্ডিংয়ে (হোটেল) থাকা-খাওয়া খুব কষ্টকর। তাও এই বয়সে আন্দোলনে যোগ দিতে হয়েছে। আমার চাকরির বয়স আসছে মাত্র তিন বছর। তবুও আন্দোলন করছি আমার মতো যাতে অন্য শিক্ষকদের, নতুন শিক্ষকদের কষ্ট না হয়।
২০০২ সালে শিক্ষকতা শুরু করেছেন জানিয়ে শিক্ষক নুরুল হক বলেন, তখন বেতন ছিল ১৭৫০ টাকা। আজ ২০২৫ এ এসে বেতন হয়েছে ৩২ হাজার ৫০০ টাকা, সব মিলিয়ে ৩৫ হাজার টাকা পাই।। এই টাকা দিয়ে কি পাঁচজনের সংসার চলে? ছেলে-মেয়েকে কি মানুষ করা যায়? তাদেরকে কি ঠিকভাবে পড়াশুনা করানো যায়? যেখানে ভরণ-পোষণই করানো যায় না, সেখানে মানুষ বানাবো কিভাবে? তারা তো অমানুষ হবেই।
নুরুল হক বলেন, আমাদের চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা। কিন্তু আপনে দেখেন, ৬০-৬৫ বছর বয়সী একজন মানুষের ৫০০ টাকার ওষুধে কোনো কাজ হয়? অন্তত তিন থেকে চার হাজার টাকা লাগে। এভাবে জীবন চলে না।
সিনিয়র এই শিক্ষকের দাবি, একজন অনার্স বা মাস্টার্স পাশ ছেলে কিংবা মেয়ে কখনোই সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতে চাইবে না। অথচ এই বেতন দিয়েই বর্তমানে একজন শিক্ষকের চাকরি শুরু করতে হয়। তাই আমরা এবার আমাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
যারাই রাস্তায় নামে, যারাই আন্দোলন করে, সরকার সবার দাবি মানে। সবার কথা শুনে। কিন্তু আমাদের দাবি মানে না। আমাদের কথা বললে বলে, টাকা নেই। এই জন্যই কি আমাদের ছাত্ররা জীবন দিয়েছে? প্রশ্ন রাখেন নুরুল হক।
তিন দফা দাবিতে গত ১২ অক্টোবর থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের ব্যানারে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া, ১ হাজার ৫০০ টাকা মেডিকেল ভাতা ও কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করার দাবিতে তাদের এই আন্দোলন।
এদিকে শিক্ষকদের এই আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানান শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার। গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, ১ নভেম্বর থেকে ৫ শতাংশ বাড়িভাড়া তারা দিতে পারবে এবং সেটি ন্যূনতম ২ হাজার টাকা থাকবে। এখন যেখানে টাকা নেই, সেখানে এর থেকে বেশি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এটা শিক্ষক-কর্মচারীদের জানানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীরা সেই প্রস্তাবে রাজি নন। তারা বলেছেন, এখন ১০ শতাংশ দিতে হবে, সামনের বছর ১০ শতাংশ দিতে হবে।
মাধ্যমিক স্কুল কিংবা মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের সময় একজন শিক্ষকের মূল বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও বিশেষ প্রণোদনা ১ হাজার টাকা যুক্ত হয়।
আর মূল বেতন থেকে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের নামে ১০ শতাংশ কেটে রাখা হয়। সব মিলে একজন সহকারী শিক্ষক বেতন পান ১৩ হাজার ৭৫০ টাকা।
কলেজের ক্ষেত্রে মূল বেতন ২২ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ ও বিশেষ প্রণোদনা অন্তত ১ হাজার যুক্ত হয়। আর মূল বেতনের ১০ শতাংশ কেটে রাখা হয়। সব মিলে একজন প্রভাষক বেতন পান ২২ হাজার ৩০০ টাকা।
চাকরির অন্যান্য সুবিধা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়ার কথা থাকলেও দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান থেকে তা দেওয়া হয় না।