কক্সবাজার এখন একটি গ্লোবাল হাব

স্থানীয় উন্নয়ন থেকে আন্তর্জাতিক সংযোগে উত্তরণের আলোচনায় নতুন দিগন্ত কক্সবাজার আর কেবল বাংলাদেশের একটি উপকূল নয়—এটি এখন আন্তর্জাতিক ব্যবসা, পর্যটন, নীল অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু। এই উপলব্ধিটিই প্রতিফলিত হয়েছে আজ শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায়।
আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল-‘কক্সবাজারের উন্নয়ন যাত্রার জোয়ার ভাটা: সমস্যা, সম্ভাবনা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিত।’ আয়োজক ছিল কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্স ঢাকার।
দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীরা সংলাপে অংশ নেন।
তাঁদের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়—কক্সবাজার এখন একটি গ্লোবাল হাব, যেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনা, পরিবেশ সুরক্ষা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা—এই তিনটি ধারা একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আলোচনায় কৌশলগত আলোচনার সারাংশে উঠে আসে—মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও সুশাসন, আঞ্চলিক সংযোগ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, পরিবেশ ও সমুদ্র নিরাপত্তা এবং স্থানীয় সম্পদের ন্যায্য ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়ন—এই চার দিকই কক্সবাজারের টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনের মূল কৌশল হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বক্তারা বলেন, কক্সবাজারের উন্নয়ন কেবল জাতীয় ইস্যু নয়, এটি এখন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের অংশ—বঙ্গোপসাগরের অর্থনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
কমিউনিটি অ্যালায়েন্সের সাম্প্রতিক জরিপের তথ্য আলোচনায় কার্যকর ভূমিকা রাখে।
১৩৪ জন উত্তরদাতার মতামত অনুযায়ী—
• ৮৬% নাগরিক মনে করেন, পর্যটনই কক্সবাজারের অর্থনীতির চালিকা শক্তি।
• ৮৪% রোহিঙ্গা সংকটকে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন।
• ৯২% চান চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক দ্রুত ৬-লেনে উন্নীত হোক।
• ৬০% পরিবেশ রক্ষায় বালিয়াড়ি ও পাহাড় দখলমুক্তকরণকে সর্বাধিক জরুরি মনে করেন।
এই তথ্যগুলো আলোচনায় নীতিনির্ধারকদের জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
বক্তারা বলেন, এই তথ্যভিত্তিক বাস্তবতা প্রমাণ করে—কক্সবাজারের উন্নয়ন এখন আর সম্ভাবনার প্রশ্ন নয় বরং কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় এসেছে।
সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, বলেন, রাষ্ট্রকে দেওয়ার মতো কক্সবাজারের অনেক কিছু আছে—অসীম প্রাকৃতিক সম্পদ, সমুদ্র অর্থনীতি ও সম্ভাবনাময় মানুষ। এই উন্নয়নকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে এনে জনগণ ও স্থানীয় নেতৃত্বের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আগামীর কক্সবাজার হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির মূল কেন্দ্র হবে কক্সবাজার।
কক্সবাজারের খনিজ নিয়ে প্রযুক্তিবান্ধব সম্ভাবনা তুলে ধরে তিনি বলেন, গবেষণা পরিকল্পনায় গুরুত্ব দরকার। স্থানীয় জনগণের স্বার্থ বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন মানসম্মত হবে না বলে মত দেন তিনি।
রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণের ওপরও গুরুত্ব দেন। তিনি চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের ছয় লেইন করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
সাবেক সাংসদ ও বিএনপির নির্বাহী সদস্য ইঞ্জিনিয়ার সহিদুজ্জামান বলেন, কক্সবাজারের টেকসই উন্নয়নে রাজনৈতিক ঐক্য ও দূরদর্শী নেতৃত্ব অপরিহার্য। পর্যটন নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মৎস্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের দাবি। তিনি তাঁর বাবা, অবিভক্ত পাকিস্তানের সাবেক শ্রমমন্ত্রী মৌলভী ফরিদ আহমদের মৎস্য পরিকল্পনার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্মরণ করে বলেন, বঙ্গোপসাগর ঘিরে একটি জাতীয় মৎস্য পরিকল্পনা প্রণয়ন সময়োপযোগী হবে—যা কক্সবাজারের অর্থনীতি ও জীবিকার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তিনি কক্সবাজারের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক, পেশাজীবীদের ঐক্য ও একই প্লাটফর্মে আসার ওপর গুরুত্ব দেন।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিশুদ্ধ পানি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখন কক্সবাজারের বড় সংকট। স্থানীয়দের সম্পৃক্ত না করলে কোনো প্রকল্প টেকসই হবে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর ফখরুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজারকে তাইওয়ানের আদলে প্রযুক্তি বান্ধব নগরিতে রূপান্তর সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালইয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আশফাক হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট শুধু মানবিক নয়, এটি ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন। এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ন্যায়সঙ্গত নীতি জরুরি।
সাবেক সচিব মিসেস মাফরুহা সুলতানা বলেন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক সুশাসনের মাধ্যমে কক্সবাজারকে কার্যকরি করা সম্ভব।
ডাকসুর মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক ফাতিমা তাসনিম জুমা বলেন, কক্সবাজারের উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ ও তরুণ নেতৃত্বের কণ্ঠস্বর শোনা জরুরি। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের ভুমিকা অগ্রগণ্য। তিনি মাদক নিরুপনে রাজনৈতিক কৌশলের ওপর গুরুত্ব দেন।
এনসিপি নেতা এম এম সুজা উদ্দিন বলেন, কক্সবাজারের অর্থনীতি মানে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি মানে কক্সবাজারের অর্থনীতি। কক্সবাজারের উন্নয়নের জন্য বিপ্লবের সময় এসেছে। কক্সবাজারের উন্নয়নে তরুণদের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তরুণ প্রজন্মের জন্য সুযোগ ও আস্থা তৈরি করতে হবে।
এবি পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কাসেম বলেন, কক্সবাজার এখন জাতীয় অর্থনীতির ফ্রন্টলাইন জোন। এজন্য স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক সমন্বয় এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা স্থায়ী হবে না।
আলোচনায় বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় কক্সবাজারে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা।
বক্তারা বলেন, উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে স্থানীয় তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা ও নেতৃত্ব বিকাশ নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগ সময়োপযোগী।
একই সঙ্গে তাঁরা কক্সবাজারের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিকটিও তুলে ধরেন—রামু ও মহেশখালীর প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র, বৌদ্ধ ঐতিহ্য এবং বঙ্গোপসাগর দিয়ে জ্ঞান ও বাণিজ্য আগমনের ইতিহাসকে তাঁরা কক্সবাজারের শিক্ষার শিকড় হিসেবে উল্লেখ করেন।
বক্তারা বলেন, উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র গড়ে উঠলে কক্সবাজারের তরুণ প্রজন্ম স্থানীয়ভাবে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে।
এছাড়া জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা এবং লবণ শিল্পের বিকাশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা—এই তিন খাতকে কক্সবাজারের সামাজিক স্থিতিশীলতার অপরিহার্য শর্ত হিসেবে দেখা হয়।
বক্তারা কক্সবাজারে সাম্প্রতিক বালিয়াড়ি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম ও সৈকত পরিচ্ছন্নতা উদ্যোগকে ইতিবাচক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তাঁদের মতে, প্রকৃতি পুনরুদ্ধার শুধু পরিবেশ নয়, এটি পর্যটনের টেকসই বিনিয়োগ হিসেবেও বিবেচ্য।
অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন সিআইপিআরবির জ্যৈষ্ঠ পরামর্শক ড. সাইকুল ইসলাম হেলাল, এলজিইডি প্রকৌশলী মনজুর সাদেক, জনপ্রতিনিধি শাফায়েত আজিজ রাজু, প্রফেসর নাদিম খন্দকার, ডক্টর নাসির উদ্দিন, স্থপতি আসিফ আহছানুল হোক এবং কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্স ঢাকার সংগঠকবৃন্দ—হেদায়েত আজিজ মিঠু, শাহনেওয়াজ চৌধুরী, সাজেদুল আলম মুরাদ, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, নাজমুল হুদা আজাদ, খোবায়েব মোহাম্মদ শাইখ, ইশতিয়াক তাসবির ও তাজওয়ার কাশেম।
উদ্বোধনী বক্তব্যে কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্স ঢাকার প্রধান সমন্বয়ক মোহিব্বুল মোক্তাদির তানিম বলেন, কক্সবাজার বাংলাদেশের উপকূল নয়, এটি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কৌশলগত দিগন্ত। মানুষ, প্রকৃতি ও সম্ভাবনাকে একত্র করে আমরা দায়িত্বশীল উন্নয়নের ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
তিনি বলেন, প্রধান সমন্বয়ক গত এক বছরে দুটি সংলাপ আয়োজন করেছে —নতুন কক্সবাজার: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার পথে ও কক্সবাজার সংলাপ: যুক্তির তীরে সম্ভাবনার আলো—যেগুলো নীতিনির্ধারণী অঙ্গনে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
বক্তারা একমত হন কক্সবাজারের উন্নয়ন হতে হবে মানুষকেন্দ্রিক, পরিবেশবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক। পর্যটন, নিরাপত্তা, শিক্ষা, পরিবেশ ও অবকাঠামো—এই পাঁচ স্তম্ভের সমন্বয়ে কক্সবাজার গড়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার এক অনন্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে।