সরকারের কাছে জমা দেওয়া ‘জুলাই সনদে’ যে কারণে আপত্তি বিএনপির
জুলাই জাতীয় সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর গত দুদিন এটি নিয়ে চলছে নানামুখী বিতর্ক। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিও আপত্তি তুলেছে। দলটি মনে করছে, এই ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্য তৈরি করেছে।
গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বাংলাদেশের ২৫টি রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে এতে স্বাক্ষর করে। এই সনদে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসনিক সংস্কার সংক্রান্ত বিভিন্ন অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এরপর ২৮ অক্টোবর (মঙ্গলবার) জুলাই সনদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়।
এর দুদিন পর আজ বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জুলাই সনদের প্রস্তাবিত দফাগুলোর ওপরে গণভোট হবে। অথচ ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, ভিন্নমত ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমূলকভাবে জাতির উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট অংশ নেয়। ১৬৬টি সংস্কারের প্রস্তাব আলোচিত হয়। এর ৮২টি বাদ পড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তিতে। যেসব সংস্কারের সুপারিশে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দল একমত হয়েছে সেগুলোই সনদে রাখা রয়েছে। কোন সুপারিশে কোন দলের ভিন্নমত রয়েছে তাও উল্লেখ ছিল প্রস্তাবগুলোতে।
জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে। এরমধ্যে ৬১টিতে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবের একাধিক ধাপ রয়েছে। বিভিন্ন ধাপসহ হিসাব করলে ‘নোট অব ডিসেন্টে’র সংখ্যা শতাধিক। সবচেয়ে বেশি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) দিয়েছে বামপন্থি দলগুলো। ৯টি মৌলিক সংস্কারসহ ১৫টি সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি ভিন্নমত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ৭টি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দুটি সংস্কার প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে।
সুপারিশ অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ গণভোটে অনুমোদিত হলে আগামী নির্বাচনে সংসদ এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। এমপিরাই হবেন পরিষদের সদস্য। সংসদ এবং পরিষদ একসঙ্গে চলবে। পরিষদ সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবে। সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুযায়ী সাংবিধানিক সংস্কারে বাধ্য থাকবে। না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের রেখে যাওয়া সংবিধান সংশোধনের বিল পাস বলে গণ্য করা হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগসহ যেসব সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, নির্বাচনে জয়ী হলে দলটি তা বাস্তবায়ন করবে না।
দলটির দাবির মুখে গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরের আগের দিন জুলাই সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ যুক্ত করা হয়। সনদে পাদটিকা যুক্ত করে বলা হয়, যে সংস্কারে যে দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে, নির্বাচনী ইশতেহারে তা রেখে জয়ী হলে আগামী সংসদে সেভাবে বাস্তবায়নের এখতিয়ার রাখবে তারা।
কিন্তু ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দেয় তাতে কোনো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উল্লেখ নেই। এখানেই আপত্তি বিএনপির। শুধু তাই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও উল্লেখ নেই বলেও জানানো হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।
এসব বিষয়ে আজ সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনের আগে প্রস্তাবিত গণভোট সম্ভব নয়। সময়, অর্থ ও নির্বাচনের মতো বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় এটি অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত।
দীর্ঘ এক বছর ধরে সংস্কার ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা অর্থহীন, প্রহসনমূলক এবং জাতির সাথে প্রতারণার শামিল ছিল বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার এখতিয়ার সরকারের নেই— এমন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার আমলেই নেয়নি। প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার শেষ করতে ব্যর্থ হলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, হাস্যকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর যেকোনো বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পরই কেবল আইনে পরিণত হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনটা হলে তা গণতান্ত্রিক রীতি ও সংসদীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি হবে।
তিনি বলেন, দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি জাতীয় অর্থনীতি বিকাশসহ সকল বিষয়ে যুগান্তকারী সব সংস্কার ও উন্নয়ন করেছে বিএনপি। আমরা আন্তরিকভাবেই চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সাফল্য কামনা করি। কিন্তু একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের অবস্থান গ্রহণ ও প্রকাশে আমরা দ্বায়বদ্ধ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গণতন্ত্রে ভিন্ন মত থাকবেই। ভিন্ন মত উপেক্ষার মত শক্তি কারও নেই। তারা (সরকার) ইচ্ছামতো সংবিধান পরির্বতন করবে— বিষয়টা এমন নয়। আদেশের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করার নজির নেই। সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। ফলে যা খুশি তাই করা যাবে না। আদেশ দিয়ে সংবিধান বদলে দেবেন— এটা হবে না।
বর্তমান সংকট উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবাই মিলে গণতন্ত্রিকভাবে উত্তরণের পথ বের করতে হবে।’ জুলাই সনদ নিয়ে সংকট জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও মনে করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বলা হয়েছে, এই ৮৪ দফার ওপরেই গণভোট হবে। এখানে কে কী মতামত দিল, কীভাবে উল্লেখ করা হলো, কীভাবে সম্মত হলো, কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। এই সমস্ত পরিকল্পনা বা প্রস্তাব হঠাৎ করে নিয়ে সুপারিশ দেওয়া এবং জাতিকে বিভ্রান্ত করা, অনৈক্য সৃষ্টি করা, বিভক্ত করা তো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কর্ম হতে পারে না।
তিনি বলেন, এখন দেখতে পারছি, অনৈক্য সৃষ্টি করছে, বিভক্তি সৃষ্টি করছে। সেটার কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, আমরা জানি না।
সংবিধান সংস্কার পরিষদ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়ে তিনি বলেন, হঠাৎ করেই সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের যে প্রস্তাবটা দেওয়া হলো এবং সেটা কারা দিল, কীভাবে দিল, সুপারিশে কীভাবে এলো? সংবিধানের বিভিন্ন স্পষ্ট নির্দেশনা অনুসারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে আমরা যেভাবে সম্মত হয়েছি, সেভাবেই আমরা এই জুলাই জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সেটা পূর্ণাঙ্গভাবে আইনি রূপ পাবে এবং সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। এই লক্ষ্যে কাজ করার জন্য সরকার, জাতীয় কমিশন এবং সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

মাহমুদুল হাসান