পাঁচ অভিযোগে শেখ হাসিনা ও কামাল-মামুনের বিচার
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আগামী সোমবার (১৭ নভেম্বর) মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণবিক্ষোভে প্রায় এক হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি এবং প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারাত্মক আহত করার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে এই মামলা হয়।
গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আলোচিত এই মামলার রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এই মামলায় বিচারের জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়। বিচার চলাকালে মোট ৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত অডিও, ভিডিও এবং অন্যান্য প্রমাণ আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তবে মামলার আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে অন্য আসামিদের সব অপরাধের বর্ণনা দেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত তিনজনের প্যানেল এই রায় ঘোষণা করবেন।
শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আমলে নেওয়া অভিযোগগুলো হলো :
প্রথম অভিযোগ—রাজাকারের বাচ্চা বলে হত্যার উসকানি : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। তার ওই উসকানিমূলক বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক হারে পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা-আক্রমণ করে। তাদের গুলি ও হামলায় প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হয়। আহত হয় প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
দ্বিতীয় অভিযোগ—প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার : হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই।
আরও পড়ুন : হাসিনার ন্যারেটিভ জেন-জিরা ভেঙে দিয়েছে, একশ বছরে বিরল : চিফ প্রসিকিউটর
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের কাছেও এই নির্দেশ পৌঁছে যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ দায় বা সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের ওপর বর্তায়।
তৃতীয় অভিযোগ—আবু সাঈদ হত্যা : ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তাঁর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনার দায় চাপিয়ে নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলাও করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন, আলামত নষ্ট এবং পাল্টা মিথ্যা মামলা করা হয়। এর মাধ্যমে এই তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
চতুর্থ অভিযোগ—চানখারপুলে আনাসসহ ছয় হত্যা : গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চানখারপুল এলাকায় শাহরিয়ার খান আনাসসহ (শহীদ আনাস) ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ—আশুলিয়ায় মরদেহ পোড়ানো : গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার সময় ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে তাদের মরদেহ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন
আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আ্যক্ট ১৯৭৩-এর বিধান অনুযায়ী, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে অনেকের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির রায় কার্যকর করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে আরও বেশ কয়েকজনের বিচার চলছিল।
তবে ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনালের আগের বিচারককে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমনপীড়নকে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী’ অপরাধ বিবেচনা করে একই ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ১৪ অক্টোবর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করা হয়।
পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে মামলা
২০২৪ সালের ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সারা দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, ১৪ দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক ও পলাতক শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৫৬টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন কার্যালয়ে জমা পড়ে। এর মধ্যে ৫৪টি অভিযোগেই প্রধান আসামি হিসেবে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে যৌথভাবে তদন্ত শুরু করে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন।
প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য শুরুতে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি আসামিদের গ্রেপ্তার করে ১৮ নভেম্বর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির এবং তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেন। প্রথমে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হলে পরে কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১২ মে প্রসিকিউশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রসিকিউশন একাধিক মামলা করে। এর মধ্যে ১ জুন প্রথম মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়।
আরও পড়ুন : মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের মুখে শেখ হাসিনা : টেলিগ্রাফ
শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় মোট ৮১ জনকে সাক্ষী করার জন্য ট্রাইব্যুনালে তালিকা জমা দেওয়া হয়। এরপর গত অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত অডিও, ভিডিও ও প্রতিবেদন প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম, মিজানুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার পালোয়ান, ব্যারিস্টার শাইখ মাহাদী, তারিকুল ইসলাম প্রমুখ।
অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন রাষ্ট্রপক্ষ নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আমির হোসেন শেখ হাসিনা সরকারের সময় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে প্রথমে তার ব্যক্তিগত আইনজীবী আমজাদ হোসেন মামলা পরিচালনা করেন। পরে তিনি রাজসাক্ষী হন। তিনি জুলাই-আগস্ট গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। পরে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব ঘটনার বর্ণনা দেন।

জাকের হোসেন