শেখ হাসিনা কেন নির্দোষ? যুক্তি দিলেন আইনজীবী
সরকার চালাতে গেলে কিছু ভুলত্রুটি হয়, শেখ হাসিনাও কিছু ভুল করেছেন। তার বিরুদ্ধে যেসব চার্জ আনা হয়েছে, এগুলো সঠিক নয়। আমার অভিমত, সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই আমি আমার মক্কেল নির্দোষ শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের খালাস প্রত্যাশা করি।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আসামিপক্ষে দুই দিনব্যাপী যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে এ দাবি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন।
শেখ হাসিনা ছাড়াও ট্র্যাইব্যুনাল-১ এ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে আগামীকাল সোমবার (১৭ নভেম্বর) রায় ঘোষণার দিন ধার্য রয়েছে। চলতি বছরের ২০ ও ২১ অক্টোবর ট্র্যাইব্যুনালে শেখ হাসিনার আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
ট্রাইব্যুনাল আইন নিয়ে প্রশ্ন
আসামিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের শুরুতেই রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এটা এমন একটি আইন, যেখানে হাত-পা বেঁধে নদীতে সাঁতার কাটতে বলার মতো। যেমন সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি এখানে প্রযোজ্য নয়। এখানে তা প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিল। একইসঙ্গে যখন যেভাবে প্রয়োজন, তখন সেভাবেই এই আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। তাই আইনটি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
আন্দোলন দমন ওয়াইড স্প্রেড কিংবা সিস্টেমেটিক নয়
এ মামলার আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠনের বিষয়ে প্রসিকিউশনের দেওয়া যুক্তিতর্ক খণ্ডন করে অ্যাডভোকেট আমির হোসেন বলেন, আন্দোলন দমন সরকারের ‘ওয়াইড স্প্রেড’ কিংবা ‘সিস্টেমেটিক’ পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে, এটা সঠিক নয়। এখানে সরকারের কোনো টার্গেট ছিল না। থাকলে শুধু রংপুরে আবু সাঈদ নয়, আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকায় থাকা নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলমসহ অন্যদেরও টার্গেট করে হত্যা করা হতো। এক হাজার ৫০০ আন্দোলনকারী মারা গেলেও তারা মারা যাননি। ফলে এটা টার্গেটভিত্তিক ব্যাপক মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ ছিল না। সুতরাং প্রসিকিউশনের বক্তব্য সঠিক নয়।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, টার্গেটেড মানে সবাইকে মেরে ফেলতে হবে, এটা বোঝায় না। স্বাধীনতাযুদ্ধে কোনো নেতা মারা যাননি। একাত্তরে কোনো নেতা মারা গেছেন? জবাবে আমির হোসেন বলেন, একাত্তরে তারা মারা যাবেন কেন, তারা তো সবাই ভারতে ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল আবার বলেন, এক নম্বর নেতা তো (শেখ মুজিবুর রহমান) পাকিস্তানে ছিলেন, তিনি মারা গেছেন? আ স ম আবদুর রবকে মেরেছে? আরও যাঁরা নেতা ছিলেন, সবাইকে মেরেছে? কোনো নেতা মরেননি। যারা টার্গেট করে, তাদের স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) থাকে। কাকে মারবে, কতটুকু মারবে, কোথায় মারবে, কখন মারবে। স্বাধীনতাযুদ্ধে কোনো নেতা মারা যাননি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভুল ছিল
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভুল ছিল দাবি করে যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, কোনো আন্দোলন যদি বৈধও হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের। সেটাই তারা করেছে। তবে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের আগেই কোটা পদ্ধতিকে প্রধানমন্ত্রী বিলোপ করেছেন। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হাইকোর্টে রিট করলেন। সেই রিটের রায়ে আবার কোটা পুনর্বহাল হলো। সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি দেশে বিচারকের ওপর নির্বাহী বিভাগ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, এক দিনের মধ্যে শুনানি করলেন কীভাবে? অ্যাটর্নি জেনারেল যদি না থাকে, তিনি যদি দুই মাস ছুটি নিয়ে বসে না থাকেন, এটা প্রভাব নয় কি? আপনি যদি অ্যাক্টিভলি পার্টিসিপেট না করেন, ডিস্পোজালের যদি ব্যবস্থা না করেন, আদালতকে যদি সহযোগিতা না করেন, সেটাই তো ইনফ্লুয়েন্স করা।
ট্রাইব্যুনাল এই মামলার প্রসঙ্গ টেনে আরও বলেন, সব ম্যাটারিয়ালস সরকারের হাতে। আমরা এখানে মামলা করছি, প্রসিকিউশন সাইট যদি অফ থাকে, আমরা মামলা চালাতে পারব না। … আপনি যদি অ্যাকটিভলি পার্টিসিপেট না করেন, ডিসপোজালের কোনো ব্যবস্থা না করেন, আদালতকে যদি কোঅপারেট না করেন, সেটাই তো ইনফ্লুয়েন্স (প্রভাব)।…একপর্যায়ে দেখা গেল এক বা দুই দিনের মধ্যে আপনি ফিক্সড করলেন ফর হিয়ারিং (শুনানির দিন ধার্য করলেন)।…ইউ হ্যাড অ্যা মেটিকুলাস প্ল্যান অ্যান্ড এভরিথিং ওয়াজ আন্ডার ইউর কন্ট্রোল (আপনার একটি ম্যাটিকুলাস প্ল্যান ছিল এবং সবকিছুই আপনার নিয়ন্ত্রণে)।
জবাবে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) যে হস্তক্ষেপ করেছেন, এ রকম কোনো ডকুমেন্ট আছে? ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ যেটা বলেছে, সেটা অনুমানভিত্তিক। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেননি, আপনি সে প্রমাণ দিন। তখন আইনজীবী আমির হোসেন পাল্টা প্রশ্ন করেন, তাহলে কি ধরে নেব, এই বিচারে রাষ্ট্র যা চাইবে তা–ই হবে? জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্র যা চাইবে, তা করতে হবে না। রাষ্ট্রের হাতে অনেকগুলো সুইচ আছে। যেগুলো টিপ দিয়ে বন্ধ করে ফেলা যায়। আপনি কি একমত? উত্তরে আইনজীবী বলেন, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, বর্তমান সরকার বা রাষ্ট্র সেই সুইচগুলো ব্যবহার করলেও করতে পারে?
তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রের হাতে ব্যবস্থা আছে। সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরে রায়ের প্রশ্ন যখন আসবে, তখন আমরা সরকারকে কেয়ার করি না।
তখন আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ঠিক একইভাবে কোটার মামলায়ও সবকিছু বিচার বিভাগের ওপরেই ছিল, এখানে তৎকালীন সরকারের কিছুই করার ছিল না।
শেখ হাসিনা ছাত্রদের রাজাকারের নাতিপুতি বলেননি
শেখ হাসিনা ছাত্রদের রাজাকারের নাতিপুতি বলেননি দাবি করে যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করেছে শুধু তাদেরকেই তিনি রাজাকার বলেছেন। আর এখন রাজাকার কজন আছে? সবাই তো মারা গেছে। এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাজাকার হচ্ছে একটা গালি। কারা রাজাকার ছিল, কারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল– সেটা বিচারের বিষয় নয়।
দু-একটা খারাপ কাজ বড় করে দেখা যাবে না
প্রসিকিউশনের যুক্তির বিরোধিতা করে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, এই মামলার পটভূমিতে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ছিল। প্রসিকিউশনের এ ধরনের বক্তব্য আমি মেনে নিতে পারছি না। এগুলো প্রসিকিউশনের ব্যক্তিগত বয়ান। কারণ এই সময়ে দেশে অনেক উন্নয়ন ও সুশাসন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাস্তাঘাট, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন হয়েছে।
আমির হোসেন আরও বলেন, একটি রাষ্ট্র ও পরিবারের মধ্যে অনেক মিল আছে। পরিবারের প্রধান চান সবাই ভালো থাকুক। কিন্তু ভালো করতে গিয়ে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে দু-একটা খারাপ কাজ হতেই পারে। সেটাকে বড় করে দেখা যাবে না। তা ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সময় কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ সময় অনেক কাজ পক্ষে যায়, আবার অনেক বিপক্ষে যায়। পৃথিবীর শুরু থেকেই এসব হয়ে আসছে। এ সময় মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের আমলের অনেক হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ টেনে আনেন তিনি। তিনি আরও বলেন, প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্কে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনী পছন্দ করে না। এটা সঠিক নয়। পছন্দ না হলে তাদের এত সুযোগসুবিধা দেওয়া হতো না। তা ছাড়া পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিষয়ে প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগের বিষয়ে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র্যাবসহ অন্যরা জড়িত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তো আসামিদের ছেড়ে দেননি। কঠিন বিচার হয়েছে। একই সঙ্গে আবরার হত্যা ও বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় নিজের দলের লোকদেরও বিচারের মুখোমুখি করেছেন তিনি। ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সময়ে বিচারবিহীন ব্যবস্থা ছিল, তার দলীয় লোকদের বিচার করতেন না, প্রসিকিউশনের এসব যুক্তি সঠিক নয়। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে সুপেরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটর যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলোও সঠিক নয়।
সব শেষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, সরকার চালাতে গিয়ে কিছু ভুলত্রুটি হয়, শেখ হাসিনাও করেছেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব চার্জ আনা হয়েছে, এগুলো সঠিক নয়। আমার অভিমত, সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। যেহেতু সাক্ষ্য-প্রমাণে তা প্রমাণ হয়নি, সেহেতু আমি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের খালাস প্রত্যাশা করছি।

জাকের হোসেন