বিলের ১৬ গুণ টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগ
খুলনার কয়রা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় উন্নয়ন সহায়তা তহবিলের টাকা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নামমাত্র কাজ দেখিয়ে কয়েকগুণ বেশি বিল উত্তোলন করা হয়েছে। সম্প্রতি একটি প্রকল্পে ১৫ হাজার টাকা মূল্যের পণ্য বিতরণ করে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিল উত্তোলনের বিষয়টি সামনে এসেছে।
এই অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান সরদার উপসহকারী প্রকৌশলী আফজাল হোসেনকে দুষছেন। অন্যদিকে, উপসহকারী প্রকৌশলী দায় চাপিয়েছেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ওপর।
ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় পর্যায়ে কয়রা ইউনিয়নে উন্নয়ন সহায়তা তহবিলের বরাদ্দ ছিল ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে কয়রা আছিয়া খাতুন মহিলা দাখিল মাদ্রাসার ছাত্রীদের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের জন্য ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের কাগজপত্রে দেখানো হয়, ১১৭৫ প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রতি প্যাকেট ২০০ টাকা দরে মেসার্স ফয়সাল এন্টারপ্রাইজ সরবরাহ করেছে।
তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মাদ্রাসায় মাত্র ৩০০ প্যাকেট ‘জয়া’ ব্র্যান্ডের ন্যাপকিন (প্রতি প্যাকেটের খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা) এবং ১৫০টি ছোট সাবান বিতরণ করা হয়েছে, যার মোট মূল্য আনুমানিক ১৫ হাজার টাকার বেশি নয়।
মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট (প্রধান শিক্ষক) মিজানুর রহমান বলেন, ‘চেয়ারম্যান নিজে এসে ৩০০ প্যাকেট ন্যাপকিন ও ১৫০টি ছোট সাবান দিয়ে গেছেন। আমরা ছাত্রীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছি। এর বেশি কিছু জানি না।’
এছাড়াও ২০ জন নারীকে সেলাই মেশিন প্রদানের জন্য নেওয়া ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮০০ টাকার প্রকল্পে প্রতিটি মেশিনের ক্রয়মূল্য ১৪ হাজার ২০০ টাকা দেখানো হয়েছে। অথচ এই মেশিন সাত থেকে আট হাজার টাকায় পাওয়া যায় বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে সেলাই মেশিন প্রদান প্রকল্পের ফাইলে সুফলভোগীদের কোনো তালিকা পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের জানা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও তদারকি কমিটির কোনো সভা না করে ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করে বিল পাস করা হয়েছে। এমনকি যে প্রতিষ্ঠানের নামে বিল দেখানো হয়েছে, সেই মেসার্স ফয়সাল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মনিরুজ্জামান মনু বলেন, ‘আমি কয়রা ইউনিয়নে কোনো ন্যাপকিন কিংবা সেলাই মেশিন সরবরাহ করিনি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মনোনীত কারিগরি কর্মকর্তা ও প্রকল্প তদারকি কমিটির সদস্য সচিব উপসহকারী প্রকৌশলী আফজাল হোসেন বলেন, ‘ফাইল তৈরি করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আমার কাছে পাঠায়। পরবর্তীতে ইউএনও স্যার (তৎকালীন ইউএনও রুলি বিশ্বাস) ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কথামতো মাস্টাররোল দেখে সই করেছি। বিতরণের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না।’
কয়রা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান সরদার বলেন, ‘আপনারা বলার পরে ওই প্রতিষ্ঠানে আরও ৭০০ প্যাকেট ন্যাপকিন দিয়ে এসেছি (যার খুচরা মূল্য ২৪ হাজার ৫০০ টাকা)। আর এর আগে ন্যাপকিন ও সাবান মিলে ৪৫০ প্যাকেট দেওয়া হয়।
প্রকল্পের বাকি টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে লুৎফর রহমান বলেন, সাড়ে ১৪ শতাংশ ভ্যাট ট্যাক্স রয়েছে। এ প্রকল্পে উপসহকারী প্রকৌশলীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা হয়। বিশেষ কারণে এ কাজটি করতে বাধ্য হই।
কয়রা উপজেলার তৎকালীন ইউএনও (বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক-রাজস্ব) রুলি বিশ্বাস বলেন, প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের। এখানে আমাকে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে কয়রা উপজেলার বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল বাকী বলেন, বিষয়টি জেনেছি। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তরিকুল ইসলাম, খুলনা (কয়রা-সুন্দরবন-উপকূল)