শেখ হাসিনা-কামালের মুত্যুদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে সাজা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আজ বুধবার (২৬ নভেম্বর) ৪৫৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ করেন ট্রাইব্যুনাল। রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল আবেদন করার সুযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনা-কামালের মৃত্যুদণ্ড, মামুনের ৫ বছরের কারাদণ্ড
আসামি থেকে রাজসাক্ষী বনে যাওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনার রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে : বিএনপি
শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগে বিচার শুরু হয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার সময় এসব অভিযোগকে দুটি বড় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে মোট ছয়টি অপরাধের জন্য দণ্ড ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন : যেসব অভিযোগে শেখ হাসিনা-কামালের সর্বোচ্চ দণ্ড
যে অভিযোগে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড
প্রথম অভিযোগের অধীন তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রথম ঘটনাটি হচ্ছে উসকানি, দ্বিতীয়টি হত্যা করার আদেশ, তৃতীয়টি হচ্ছে নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে শাস্তিযোগ্য। এই তিন ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনার রায়ে তিন শহীদ পরিবারে স্বস্তি
অভিযোগ উল্লেখ করে রায়ে আরও বলা হয়, অনেকগুলো ঘটনা আছে। একটি হচ্ছে আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছেন।
আরও পড়ুন : রায় ঘোষণার সময় তাসবিহ পড়ছিলেন সাবেক আইজিপি মামুন
শেখ হাসিনা আরও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যা, যা সংঘটিত হয়েছে তার আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলে বর্ণনায় এসেছে। অন্য একটি ঘটনায় তিনি একই অপরাধ করেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ। এ কারণে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই তিনটি ঘটনায় তাকে (শেখ হাসিনা) একটি সাজা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডের সাজা।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনার রায় ঘিরে ভারতের প্রতিক্রিয়া
এ সময় আদালতকক্ষে উপস্থিত অনেকে হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আপনাদের অনুরোধ করছি আদালতের ডেকোরাম বজায় রাখার জন্য। আপনাদের উচ্ছ্বাস, প্রত্যাশার প্রকাশ ট্রাইব্যুনাল কক্ষের বাইরে গিয়ে করলে সেটি আরও শোভনীয় দেখা যাবে।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনা-কামালের সম্পদ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ
যে অভিযোগে আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ড
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ঢাকার চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায়। এ ঘটনার ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে তিনি দায়ী সহযোগিতার জন্য এবং নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ ও প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য।
আরও পড়ুন : আমার ছেলের খুনি হাসিনার রায় দ্রুত কার্যকর চাই : আবু সাঈদের বাবা
উভয় (চানখাঁরপুল ও আশুলিয়া) ক্ষেত্রে ছয়জন করে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানের অধীনে আসাদুজ্জামান খান কামাল দায়ী বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে চানখারপুল ও আশুলিয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা। এসব ঘটনায় তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনার রায় ঘোষণার পর মিষ্টি বিতরণ ও উল্লাস
যে কারণে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন—পরিস্থিতি সম্পর্কে তার জানা সম্পূর্ণটা ও সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। এমনকি তিনি স্বীকার করেছেন, তিনি ৩৬ দিনের আন্দোলনের সব ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তার অবদান, স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তার সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে, যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু তার অবদান বিবেচনায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদানের।
আরও পড়ুন : যে কারণে শেখ হাসিনা আপিল করতে পারবেন না
রায়ের পর প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম সাংবাদিকদের বলেন, তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাঁচটি অভিযোগকে ছয়টি কাউন্টে (ঘটনা বা বিষয়) ভাগ করে দুটি অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া যায়। অপরাধের নৃশংসতা, গুরুত্ব ও গভীরতা বিবেচনায় তিনটি কাউন্টে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর তিনটি কাউন্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগেই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন, তিনি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য, তবে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন এবং তার দেওয়া সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালের সঠিক রায় বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করেছে—এসব দিক বিবেচনায়।
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের হুবহু কপি নিম্নরূপ
শেখ হাসিনার মামলার রায়ে মোট দুটি অভিযোগ। ৬টি কাউন্ট। অভিযোগ ১ : তিনটি কাউন্ট।
আরও পড়ুন : আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার রায়
কাউন্ট ১ : ১৪ জুলাই ২০২৪ তারিখ গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন।
আরও পড়ুন : শহীদরা ন্যায়বিচার পেয়েছে, রাষ্ট্র ন্যায়বিচার পেয়েছে : অ্যাটর্নি জেনারেল
কাউন্ট ২ : ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সাথে শেখ হাসিনার কথোপকথনে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে তাদের ফাঁসি দিব মর্মে উসকানি ও আদেশ দেন। অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তাদের অধীনস্তদের কোনো বাধা প্রদান করেননি।
আরও পড়ুন : ‘এই মাত্র খবর এলো, খুনি হাসিনার ফাঁসি হলো’
কাউন্ট ৩ : এরই ফলশ্রুতিতে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ কর্তৃক গুলি করে হত্যা।
শাস্তি : শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের আমৃত্যু কারাদণ্ড।
আরও পড়ুন : ট্রাইব্যুনালের গেটে উল্লাস, স্লোগান
অভিযোগ ২ : তিনটি কাউন্ট
কাউন্ট ১ : ১৮ জুলাই, ২৪ তারিখ শেখ হাসিনা সাথে তাপসের এবং পরবর্তীতে হাসানুল হক ইনুর সাথে কথোপকথনে দেখা যায়, আসামি শেখ হাসিনা ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়, আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হেলিকপ্টার এবং লেথাল উইপন ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তাদের অধীনস্তদের কোনো বাধা প্রদান করেননি।
আরও পড়ুন : রায় পড়ার সময় শেখ হাসিনার সেই বক্তব্যে উত্তেজনা
কাউন্ট ২ : যার ফলশ্রুতিতে ৫ আগস্ট ২০২৪ চানখাঁরপুলে ছয়জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে।
কাউন্ট ৩ : যার ফলশ্রুতিতে ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখ পুলিশ কর্তৃক আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে হত্যার পর তাদের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন : এই রায় অতীতের প্রতিশোধ নয় : চিফ প্রসিকিউটর
শাস্তি : শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ড।

নিজস্ব প্রতিবেদক