তামাকে ঝুঁকছে কৃষক, কমছে সবজি-ধানের আবাদ
লালমনিরহাটে এবার তামাকের আবাদ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। গত বছর তামাক চাষে অপ্রত্যাশিত উচ্চমূল্য পাওয়ার পর এ বছর জেলার কৃষকরা আবাদি জমির বৃহত্তর অংশে এই বিষবৃক্ষের চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাতটি দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা কৃষকদের বীজ, সার, কীটনাশক এবং সুদমুক্ত ঋণ সরবরাহ করে চাষ সম্প্রসারণে সক্রিয়ভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, তামাককে ‘বিষাক্ত ফসল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর চাষ বৃদ্ধির ফলে শীতকালীন শাকসবজি, সরিষা, গম ও ধানের মতো খাদ্য ফসলের আবাদ কমে যাচ্ছে। এতে মাটির উর্বরতা, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই সতর্কতা সত্ত্বেও, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এখনও কার্যকর কোনো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের ফলিমারি এলাকার কৃষক পবিত্র কুমার বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর আরও বেশি জমিতে তামাক চাষের প্রস্তুতি চলছে। গত বছর পাঁচ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। এ বছর দুই বিঘা বাড়িয়ে সাত বিঘায় চাষ করেছি। বীজতলা প্রস্তুত হয়ে গেছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি রোপণ শুরু হবে।
একই উপজেলার সাপ্টিবাড়ী এলাকার কৃষক আশরাফুল হক জানান, গত বছর চার বিঘা জমি থেকে তিনি ৩০ মণ তামাক উৎপাদন করেন। মণপ্রতি ৮ হাজার ৩০০ টাকায় মোট ২ লাখ ৪৯ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। উৎপাদন খরচ ছিল প্রায় ৮০ হাজার টাকা। লাভ হওয়ায় এ বছর আট বিঘা জমিতে চাষ করছি। কোম্পানির প্রতিনিধিরা আশ্বাস দিচ্ছেন, দাম আরও বাড়বে এবং বিক্রিতে কোনো সমস্যা হবে না।
একই গ্রামের কৃষক আখের আলী তার তামাক চাষের পরিমাণ চার বিঘা থেকে বাড়িয়ে ছয় বিঘায় তুলেছেন। তিনি বলেন, আমরা জানি তামাক মাটি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। তারপরও আমাদের বিকল্প কম। কোম্পানিগুলো বীজ, সার, কীটনাশক থেকে শুরু করে ঋণ- সবই দেয়। তাই লাভের আশায় চাষ চালিয়ে যেতে হয়।
জেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কৃষক সাইদুল আলী জানান, এলাকায় তামাক চাষীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। তামাক সাধারণত উর্বর জমিতেই হয়। তাই এর চাষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাকসবজি, গম, সরিষা আর ধানের আবাদ দিন দিন কমছে।
ডিএই কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, গত বছর লালমনিরহাট জেলায় তামাকের চাষ ছিল ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এ বছর তা প্রায় ২৫ হাজার হেক্টরে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের (এটিএমএ) সদস্য খোরশেদ আলম দাবি করেন, সরকারিভাবে দেখানো জমির পরিমাণের চেয়ে বাস্তবে তামাকের আবাদ প্রায় দ্বিগুণ। তিনি বলেন, এ বছর আরও বেশি জমিতে প্রস্তুতি চলছে। তামাক কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ না করলে চাষ আরও বাড়তে থাকবে।
জেলা বা উপজেলার কোনো তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিকে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য পাওয়া যায়নি। তারা গোপনীয়তা নীতির কারণ দেখিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, এ বছর তামাক চাষ ১৫-২০ শতাংশ বাড়তে পারে। অনেক কৃষক সবজি, সরিষা ও গম চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। কোম্পানিগুলো সরাসরি তাদের উৎসাহিত করছে। আমরা সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু স্বল্পমেয়াদী লাভের আশায় কৃষকরা পরামর্শ মানছেন না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. সাইখুল আরিফিন বলেন, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছি, যাতে কোম্পানিগুলো সরাসরি কৃষকদের প্রভাবিত করতে না পারে। উর্বর জমি তামাক থেকে রক্ষা করতে হবে, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় আইনগত বিধান না থাকায় তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।
আরিফিন আরও বলেন, তামাক চাষে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার মাটি, পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

মামুনুর রশিদ, লালমনিরহাট (সদর-আদিতমারী)