সোনালি শৈশব, স্বপ্নের কৈশোর
অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্ম হলেও ১৯৪৭ সালে বাবা ইস্কান্দর মজুমদার সঙ্গে সপরিবারে দিনাজপুর চলে আসেন। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
খালেদা জিয়ার বয়স তখন মাত্র দুই বছর। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে হাঁটতে শিখেছেন। মুখে কথা ফুটেছে আগেই, জলপাইগুড়ি থাকা অবস্থায়। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবেশ ছিল তখন চমৎকার। গ্রাম-গঞ্জ ও শহর এলাকা ছিল অনেকটা ফাঁকা শান্ত-স্নিগ্ধ। এত দালান-অট্টালিকা ছিল না। বাস-মোটরের মতো যান্ত্রিক যানের হুল্লোড় ছিল না। কাঠের নৌকা ও লঞ্চ আর রেলপথেই তখন মানুষ যাতায়াত করত বেশি। পাড়া-প্রতিবেশীরা একজন আরেকজনের সাহায্যে এগিয়ে আসত। মানুষের মধ্যে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। আনন্দ-উল্লাস আর নানা ধরনের বিনোদনের কমতি ছিল না। তখন পাড়ায়-মহল্লায় বুলবুলি, মোরগ আর ষাঁড়ের লড়াই দেখতে ভিড় করত মানুষ। ঘুড়ি উড়ানো ছিল শখের খেলা। নদীতে নৌকাবাইচ আর মহররমের মিছিলে জৌলুসের অন্ত ছিল না। গ্রামে-শহরে প্রায়ই বসত কাওয়ালি ও বাউল গানের আসর। গ্রামে রাতের বেলায়ই বেশির ভাগ বিয়ে হতো। বিয়ে বাড়িতে বর আসত পালকিতে চড়ে। আর সেই পালকিতে চড়েই বউ যেত শ্বশুরবাড়ি। সবুজ-শ্যামলে ভরা ছিল এই জনপদ।
ওই সময়ের এমনি মধুর পরিবেশে দিনাজপুরে বেড়ে ওঠেন খালেদা জিয়া। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই আছে আনন্দময় শৈবের স্মৃতি। মাটির পুতুল দিয়ে বর-কনে সাজানো, বিয়ে দেওয়া, ছোট্ট হাঁড়িতে মিছেমিছি রান্না করে চড়ুইভাতি খেলা, ছিপ দিয়ে মাছ ধরা, ঘুড়ি উড়ানো, কানামাছি খেলা, দুষ্টুমিতে সময় কাটিয়ে দেওয়া আরও কত কী! খালেদা জিয়ার ছোটবেলাও ছিল এমনি বর্ণাঢ্য, এমনি মধুর। দিনাজপুরেই কাটে তাঁর স্মৃতিময় শৈশব, সোনালি কৈশোর।
খালেদা জিয়ার জীবনীলেখক সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমেদের লেখা ‘নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া’ বই থেকে জানা যায়, খালেদা জিয়ার শৈশব কেটেছে দিনাজপুরের ঈদগা বস্তিতে। একটি ভাড়া বাসায়। মেজো বোন বিউটি ছিল তার সারাক্ষণের খেলার সঙ্গী। পরিবারে খালেদা জিয়াই ছিলেন সবার আদরের পুতুল। কেউ তাকে ধমক দিতে পারত না। আদর করতে হতো।
খালেদা জিয়ার সেই আনন্দময় শৈশবের বর্ণনা উঠে আসে মা বেগম তৈয়বা মজুমদার স্মৃতিচারণে। ‘পুতুল ছিল সবচেয়ে আদরের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই ও খুব সুন্দর। ওর বাবা ওকে ভীষণ আদর করত। কাউকে কিছু বলতে দিত না। প্রতিদিন ওর বাবা বাসায় এলেই ও দৌড়ে গিয়ে কোলে উঠত। ওর বাবা ওর কাছে জিজ্ঞাসা করত, কে কে আদর করেছে, কে করেনি। কেউ কিছু বলেছে কি-না। পুতুলের বয়স তখন দুই বছর। মুখে কথা ফুটেছে। আমরা জলপাইগুড়িতে। আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার অবনী গুহ একদিন আমাদের বাসায় এসে পুতুলকে কোলে নিল। অবনী গুহের গোঁফ ছিল অনেক বড়। সে পুতুলকে আদর করে বলল, “এই বুড়ি! তোকে গোঁফ দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাব।' পুতুল তখনি ওর কোল থেকে নেমে এসে আমার কাছে নালিশ করে—‘চাচ্চুটা ভালো না। আমাদের বাসায় আর ওকে আসতে দিও না। বিউটিকে নিয়ে পুতুল সারাক্ষণ খেলত। কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল নিয়ে ওরা বউ খেলায় মেতে থাকত। ছোট হাঁড়িতে বালি দিয়ে রান্না চড়াত। মিছেমিছি খাবারের ভান করত। ওদের মধ্যে কোনো দিন ঝগড়া হয়নি। পুতুলের এক দিন আঙুল কেটে গিয়েছিল, বিউটি তখন কেঁদে অস্থির।
সেই স্মৃতিময় মুহূর্ত সম্পর্কে মায়ের বর্ণনায় উঠে আসে আরও মজার মজার সব ঘটনা। ছোটবেলায় পুতুল ওর বাবার গামছাকে শাড়ি হিসেবে পরত। ওর শখ দেখে ওর বাবা একটি ছোট্ট লাল শাড়ি এনে দেয়। ওটা ও পরত। আমরা ওকে তখন বলতাম লাল টুকটুকে বউ। বিউটি যখন পড়তে বসত, পুতুলও বিউটির কাছে গিয়ে বসত। বিউটির সঙ্গে সেও পদ্য মুখস্থ করত। ওর বাবা বাসায় এলে পদ্য মুখস্থ শুনাত। ওর বাবা বলত, আমার ওই মেয়েটি বিদ্বান হবে। বইয়ের ছবি দেখতে পুতুল পাগল ছিল। নতুন বই আনলেই উলটে-পালটে ছবি দেখত। ওর বয়স তখন চার। রোজার দিন। আমরা সবাই রোজা রাখছি। সেও রোজা রাখতে প্রতিদিন কান্নাকাটি করত। আমরা বলতাম ছোট মানুষের রোজা এমনিতেই হয়। কিন্তু সে মানত না। পুতুল ‘রোজা রাখব’ বলতে পারত না। বলত ‘আম্মা আমি আজ রোজা খাব’। একদিন সে একটি রোজা রেখেই দিল। অনেক চেষ্টা করেও আমরা রোজা ভাঙাতে পারিনি। আমার সঙ্গে নামাজের বিছানায় নামাজও পড়ত। ওর বাবা এবং আমি ওকে মুখে মুখে কালেমা শিখেয়েছি। অবশ্য একটু বড় হলে মৌলানা সাহেব রেখে আমরা ওদের নামাজ ও কালেমা-কালাম শিখিয়েছি।
শবে বরাতের দিন ফকির-মিশকিনদের পুতুল হালুয়া রুটি বিলিয়ে দিত। রাতে আমাদের সঙ্গে নামাজ পড়ত। ঈদের দিনে নতুন কাপড় পরে খুব মজা করত।
ছোটবেলা থেকেই পুতুলের তেমন চাহিদা ছিল না। অন্যের নতুন জামা-কাপড় দেখে সেগুলো কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরত না। ছোটবেলায় পুতুল গান করেছে, নাচ করেছে। ওর জন্য নাচের মাস্টার রেখেছিলাম। বাসায় ও নাচ করেছে। অবশ্য একটু বড় হলে আর নাচে উৎসাহিত করিনি।
পাঁচ বছর বয়সে খালেদা জিয়ার স্কুলজীবন শুরু হয়। তার বাবা তাঁকে প্রথম দিনাজপুর মিশনারি কিন্ডার গার্টেনে ভর্তি করিয়ে দেন। মেজো বোন বিউটির সঙ্গে স্কুলে যেতেন। ছোটবেলা থেকে খালেদা জিয়া খুব পরিপাটি ও গোছানো স্বভাবের ছিলেন। খুব লাজুক ছিলেন। কম কথা বলতেন। ফুল ছিল তার খুব প্রিয়। ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং সাজিয়ে রাখা ছিল তার পছন্দের কাজ।
খালেদা জিয়ার স্কুলজীবন ও কৈশোরের নানা ঘটনাও মনে আছে মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের । তিনি সেই ঘটনাগুলোর বর্ণনা দেন “পুতুলকে ওর বাবা পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি করে দেন। প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে সে খুব খুশি। স্কুল থেকে এসে নানান গল্প করল। স্কুলের অন্য ছেলেমেয়েরা কী বলেছে, স্যার কী বলেছেন, স্যারটি কেমন—আরও কত কী! খেলাধুলা সে খুব পছন্দ করত। মিশনারি স্কুল থেকে পরে ওকে দিনাজপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি করা হলো।
আরও পড়ুন : কেউ বলল রাজকন্যা, কেউ লাল টুকটুকে মেয়ে!
স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা খেলাধুলায় মেতে থাকত পুতুল। দৌড়, লং জাম্প, মিউজিক্যাল চেয়ার, যেমন খুশি তেমন সাজো এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুতুল অংশ নিত। খেলাধুলায় বরাবরই সে প্রথম হয়েছে এবং পুরস্কার পেয়েছে। পাড়ায়ও সে খেলাধুলা করত । আমার বোন থাকত পাশের বাসায়। বোনের ছেলে-মেয়ে ছিল ১২ জন। পুতুল ও বিউটি ওদের সঙ্গেই খেলত। কানামাছি, এক্কা-দোক্কা, লুডু, কেরাম সে খেলত। কারো সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়াঝাটি হয়নি। আমার ছেলে সাঈদ ও শামীম জন্ম নেওয়ার পর পুতুল সব সময় ওদের যত্ন নিত। সাঈদকে কাপড় পরানো, শামীমকে গোসল করানো এগুলো পুতুলই করত। ওদের গান গেয়ে ও গল্প বলে জমিয়ে রাখত। ছোটবেলা থেকেই পুতুলের সঞ্চয়ের প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল। টাকা-পয়সা পেলেই রেখে দিত। প্রয়োজন না হলে খরচ করত না। ওর বাবা ওকে টাকা দিতেন। ও জমা করে রাখত। আমার অন্য মেয়েরা ওকে এ বলে ক্ষ্যাপাত যে, “তোর শ্বশুরবাড়ি গেলে তুই কিপটেমি করে ভালো কিছু খাওয়াবি না।' পুতুল হাসত।
পুতুল মাছ একেবারেই খেত না। মাংস ছিল তার পছন্দের। তরিতরকারির মধ্যে আলু ও ঢেড়স পছন্দ করত। সে ফুল কুড়িয়ে এনে মালা গেঁথে ছোট ভাইদের দিত। ফুলদানিতে ফুল রাখত, ঘর সাজাত। ওর বাবা বলত— মেয়েদের সব কাজ শিখিয়ে রাখা ভালো। ফলে আমার বড় মেয়ে চকলেট, সেজো মেয়ে বিউটি ও পুতুলকে আমরা সব ধরনের রান্না-বান্না ও অন্যান্য কাজ করতে শিখিয়েছি । পুতুল সব রান্না জানে। কৈশোরের ওদের পালা করে রান্না করতে দিতাম। এভাবেই ওরা রান্না শিখেছে।
ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দরের বর্ণনায় উঠে আসে দিনাজপুরের সেই মধুময় দিনের স্মৃতি। “মুড়ি চুরি করতে গিয়ে একদিন আমার থুতনি কেটে গিয়েছিল। ছোট আপা (খালেদা জিয়া) দৌড়ে এসে আমার থুতনি ড্রেসিং করে দেন। এর পরও রক্ত বন্ধ না হওয়ায় তিনি রিকশায় করে আমাকে নিয়ে যান দিনাজপুর পুলিশ হাসপাতালে। সেখান থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনেন। আমাকে কাপড়-চোপড় তিনিই পরাতেন। আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না। সকাল ৯টা হলেই কান্না শুরু করে দিতাম। ছোট আপা চকলেট কিনে দিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্কুলে নিতেন। ছোট আপা পড়তেন দিনাজপুর গার্লস স্কুলে, আমি পড়তাম সেন্ট জোসেফে। বাসার বলতে গেলে তাঁরই কর্তৃত্ব ছিল। ড্রইংরুমে সোফা সাজানো, বিছানা গোছগাছ করা, বাড়ি পরিষ্কার রাখা—সবই তিনি করতেন। অন্য কেউ এগুলো করলে তার পছন্দ হতো না। অবশ্য তিনি যেটা সাজাতেন সেটা সবারই ভালো লাগত। আসলে ছোটবেলা থেকেই তার 'চয়েস' ছিল আলাদা এবং নিখুঁত।
আরও পড়ুন : আপসহীন নক্ষত্রের বিদায়
একবার চুড়ি ভেঙে ছোট আপার হাত কেটে গিয়েছিল। অনেক রক্ত পড়েছিল। আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু উনি হেসে বললেন, 'ও কিছু না।’ আমরা আব্বা-আম্মা ভাইবোন সবাই একত্রে বসে খেতাম। আব্বা ব্রিটিশ আমলের গল্প করতেন। সে সময় কত টাকায় কত দুধ পাওয়া যেতো, কত চাল পাওয়া যেতো ইত্যাদি। আব্বা খুব সংস্কৃতিমনা ছিলেন। কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার কেমন করে দেখা হলো, কী আলাপ হলো বলতেন। ছোট আপা প্রশ্ন করে করে আব্বার কাছ থেকে খুঁটিয়ে মজার তথ্য বের করতেন।
বড় বোন খুরশীদ জাহানেরও খালেদা জিয়ার শৈশব নিয়ে অনেক স্মৃতি। ‘রান্নাঘরে বসে আম্মা আমাদের নিয়ে গল্প করতেন। নানা-নানীর গল্পই বেশি বলতেন। বিউটি, পুতুল ও আমার সঙ্গে আম্মা-আব্বার সম্পর্ক ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো। তবে গুরুজনদের মান্য করার ব্যাপারে আব্বা-আম্মা আমাদের আদব-কায়দা শেখাতেন। পুতুলকে স্কুলে ভর্তি করার আনুমানিক দুই বছর পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। বাংলা ভাষার জন্য ঢাকায় অনেক শহীদ হয়েছে, ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে—এ খবর আমরা দিনাজপুরে শুনেছিলাম। এ সময় পুতুল আম্মা, আব্বা ও আমাদের বার বার জিজ্ঞাসা করত কেন পাঞ্জাবিরা গুলি চালাল, তারা কেন উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায় ইত্যাদি। ছোটবেলা থেকেই পুতুলের স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। একবার যেটা পড়ত, মনে রাখতে পারত। খেলাধুলা করত বলে সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পড়ত। আব্বা রাত ৯টার মধ্যে বাসায় ফিরতেন। আব্বার আওয়াজ পেলেই পুতুল বিছানায় থেকেই মুখস্থ পড়া শুরু করে দিত। কোথায় বই, কোথায় খাতা তার ঠিকানা নেই। সে উচ্চস্বরে আওয়াজ করে পড়ছে। আব্বা যাতে বুঝতে পারেন পুতুল পড়ছে। এ নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। ওর শৈশব-কৈশোরের ১৫টা বছরই কাটে দিনাজপুরে।’
আরও পড়ুন : শেষ সময়ে খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন যারা
খালেদা জিয়ার সারাক্ষণের সঙ্গী মেজো বোন সেলিম ইসলাম বিউটির চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মধুময় দিনগুলো। ‘আমরা এক বিছানায় ঘুমাতাম। শীতের দিনে লেপ নিয়ে টানাটানি করতাম। একটু আধটু ঝগড়াও হয়েছে। পুতুল আমাকে ছোটবেলা থেকেই নাম ধরে ডাকত। আম্মা-আব্বা ওকে বলতেন আমাকে আপা ডাকার জন্য। কিন্তু পুতুল বলত লম্বায় সে আমার চেয়ে ছোট। পুতুল আমাকে ভেংচি কাটত আর বলত ওকে আবার আপা ডাকব কেন? আমি তো ওর চেয়ে অনেক বড়। আমরা দুই বোন মাঠে খেলতে যেতাম। তবে পুতুলের সঙ্গে দৌড়ে পারতাম না। একবার রাগারাগি করে আমরা কথা বলাও বন্ধ রেখেছিলাম। পুতুল আমার সঙ্গে আড়ি দিয়েছিল। আব্বা আমাদের দুজনের মধ্যে রাগ ভাঙান।’

জাকের হোসেন