পিলখানা হত্যাকাণ্ড : ১১ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক মামলার বিচার
রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার বিচারকাজ ১১ বছরেও শেষ হয়নি।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিপথগামী কিছু বিডিআর সদস্য বিডিআরের তখনকার মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিল। এ ছাড়া নারী ও শিশুসহ আরো ১৭ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সেদিন।
উচ্চ আদালতে পিলখানা হত্যা মামলাটির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের ৮ জানুয়ারি। যদিও রায়ের সার্টিফায়েড কপি তুলতে না পেরে এখনো আপিল বিভাগে মামলার আবেদন ফাইল জমা দিতে পারেননি আসামিপক্ষের আইনজীবী। এ ছাড়া বিস্ফোরক মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতে চলমান রয়েছে। এই মামলায় আট হাজার ২৮৭ জন বিভিন্ন মেয়াদে লঘুদণ্ড পেয়ে বিজিবিতেই বহাল রয়েছেন। আর হত্যা মামলায় ১৩৯ জনকে ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড, ২৭৮ জনকে খালাস এবং চারজন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তারা অব্যাহতি পায়।
আদালতের রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসামিরা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিল করেন। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই বিডিআরের সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহাম্মেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহাম্মেদ পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। একই সঙ্গে আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। অন্যদিকে এ মামলার অন্যতম আসামি বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টু হাইকোর্টের বিচার চলার সময়ে মারা যান। এ ছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এদের মধ্যে দুজন আসামির মৃত্যু হয়েছে এবং ১২ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা হিসেবে পরিচিত এটি। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।
তবে এখনো বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। বর্তমানে মামলাটি রাজধানীর বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারিক কার্যক্রম চলছে।
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে আলাদা মামলা হয়। মামলার পরে ১৪৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য আছে।’
ফারুক আহম্মেদ আরো বলেন, ‘এ মামলা দায়েরের পরে ১১ বছর কেটে গেছে। এখনো বিস্ফোরক আইনের মামলাটির বিচার শেষ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষই হত্যা মামলায় রায় পাওয়ার পর বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির করার চেষ্টা করছে না। হত্যা মামলার খালাসপ্রাপ্ত ২৭৮ আসামি বিস্ফোরক মামলারও আসামি। হত্যা মামলায় খালাস পেয়েও বিস্ফোরক আইনের মামলার কারণে তাঁরা মুক্তি পাননি। তাই উচিত হবে যাঁরা হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন, তাঁদের জামিন দেওয়া, না হয় বিস্ফোরক আইনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা।’
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘একই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচার নিম্ন আদালতের পর হাইকোর্ট পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। নিয়মিত সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে।’
নথি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর কিছু উচ্ছৃঙ্খল জওয়ান বিদ্রোহ শুরু করে। এ সময় তাদের গুলিতে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন।
এর পরে এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে প্রথমে চকবাজার থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়। মামলার পরে ২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা মামলায় এবং ২৭ জুলাই বিস্ফোরক আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি।
পরে ২০১১ সালের ১০ আগস্ট হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হলেও বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার স্থগিত ছিল। হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে ২০১৩ সালের ১৩ মে বিস্ফোরক আইনের মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। হত্যা মামলায় চার বছর আট মাসে ২৩২টি কার্যদিবস পর ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণা হয়।