মোস্তফা কামাল সৈয়দকে স্মরণ

নিপাট ভদ্রলোক, নির্মাতাদের ক্যারিয়ারের দিকপাল

Looks like you've blocked notifications!
মোস্তফা কামাল সৈয়দের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন বিনোদন অঙ্গনের মানুষেরা। ছবি : কোলাজ

গণমাধ্যম, বিনোদনসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষকে কাঁদিয়ে জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান, বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর মোস্তফা কামাল সৈয়দ গত বছরের ৩১ মে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আজ এই বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি কেউ।

প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে এনটিভি অনলাইনের কাছে তাঁকে স্মরণ করেছেন খ্যাতিমান অভিনেতা আবুল হায়াতসহ একাধিক নির্মাতা, যাঁরা তাঁর হাত ধরে নির্মাণে সফলতা পেয়েছেন।

আবুল হায়াত, খ্যাতিমান অভিনেতা

নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। প্রায় অর্ধশতাব্দীর পরিচয় এই মানুষটার সঙ্গে অথচ কোনোদিন হাসিমুখে ছাড়া কথা বলতে দেখিনি তাঁকে। কঠিন কথাগুলোও কেমন সুন্দর করে গুছিয়ে নরম সুরে বলাটা ছিল তাঁর সহজাত ব্যাপার। উচ্চস্বরে কখনও দেখিনি বা শুনিনি।

ভরাট মিষ্টি মায়াময় কণ্ঠের অধিকারী কামাল সাহেবের কণ্ঠ আজও কোনো কোনো চ্যানেলে ধ্বনিত হয়... নাটকের নায়ক থেকে একসময় চলে আসেন টেলিভিশনে, এখানেই আমার সঙ্গে পরিচয়।

তাঁর নির্দেশনায় খুব বেশি নাটক করা হয়নি আমার, তবে যে কয়েকটি করেছি তাতে বোঝা গেছে, কতটা গোছানো প্রকৃতির। এলোমেলো কাজ তাঁর খুবই অপছন্দ ছিল। ব্যক্তিজীবনেও শুনেছি তাই। প্রায় সামাজিক অনুষ্ঠানে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন, হাস্যোজ্জ্বল দম্পতিকে দেখলেই বোঝা যেত কত স্বচ্ছ আনন্দময় জীবন ছিল তাঁর। কোনো ঝুট-ঝামেলায় তিনি কখনও জড়াতেন না। এমনকি এই মানুষটা একটা মোবাইল ফোন কখনও ব্যবহার করেননি।

হেসে কখনও জিজ্ঞেস করতাম, জরুরি সময়ে আপনাকে পাব কী করে? তিনিও হেসে বলতেন, আপনার ভারী স্বরে খবর দিলে আমি পেয়ে যাব।

ক্রিকেটপাগল মানুষ। কাজপাগলও বটে। শেষ জীবনটা কেটেছে এনটিভির অনুষ্ঠানপ্রধান হয়ে। সেখানে তাঁর কাজের নিষ্ঠা ছিল অতুলনীয়। যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরা কেউ তাঁকে কখনও ভুলতে পারবেন না। এক হিসেবে তিনি ছিলেন তাঁদের শিক্ষক। নাটক প্রিভিউ যখন করতেন, বিটিভিতে রাতে... দেখেছি তো। কী একাগ্রতা নিয়ে নাটকগুলো দেখতেন...

তাঁর প্রয়াণ আমাদের মিডিয়ায় এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে তো অবশ্যই, সেই সাথে আমদের সুধীসমাজ হারিয়েছে একজন অসামান্য মেধাসম্পন্ন সুশীল ব্যক্তিকে। সালাম আপনাকে মোস্তফা কামাল সৈয়দ সাহেব।

সালাউদ্দিন লাভলু, নির্মাতা ও সভাপতি, ডিরেক্টরস গিল্ড

কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বিটিভির সময় থেকে। উনি বিটিভিতে থাকার সময় উনার সঙ্গে বেশ কয়েকটি কাজ করেছি। উনি মেকার হিসেবে আমাকে খুব পছন্দ করতেন। এরপর উনি এনটিভিতে এলেন। এনটিভির প্রথম ধারাবাহিক ছিল ‘রঙের মানুষ’। আমার করা, উনার জন্য আমার বেশ কয়েকটি পর্ব পরিবর্তন করতে হয়েছিল। তার ফলাফল এনটিভির ‘রঙের মানুষ’ সুপারহিট। এরপর বহুবার কথাবার্তা হয়েছে আমাদের, আমার খোঁজখবর নিতেন। উনি জুনিয়রদের কদর ও সম্মান করতে পারতেন। আমি উনার বয়সে খুব ছোট, কিন্তু আমাকে আপনি করে কথা বলতেন। আমি অনেক বার বলেছি, কিন্তু উনি বলতেন আপনি করে বলতেই আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। উনার পরামর্শ যারা একবার পেয়েছে, তারা টেলিভিশন নাটক নিয়ে কখনও ভুল করবে না বলে আমি মনে করি। উনি পুরোপুরি একজন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, টেলিভিশনের উন্নয়নের বাইরে উনি কিছু ভাবতেই পারতেন না। সবশেষ ‘বুকের ভিতর নকুল বাজে’ শিরোনামের একটি নাটক করেছিলাম। এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, উনি আমাকে বলেছেন, আপনার সঙ্গে বসে নাটকটি দেখতে চাই। এক বসায় নাটকটি দেখছিলেন, মাঝে নামাজের বিরতি নিয়েছিলেন শুধু। মানসিকভাবে উনি খুব কাছের মানুষ ছিলেন, উনার মৃত্যুতে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি একজন বটবৃক্ষ হারিয়েছে।

মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, নির্মাতা

আমার ক্যারিয়ারে আমার বস মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পর উনার অবদান। উনি আমার অভিভাবকের মতো ছিলেন। উনাকে আল্লাহ বেহেশত নসিব করুন।

আশফাক নিপুণ, নির্মাতা

আমার প্রথম কাজ এনটিভির সঙ্গে, ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’। তাহসান-মিথিলারও প্রথম কাজ একসঙ্গে। শুটিং করার আগে আমি যখন উনার (মোস্তফা কামাল সৈয়দ) কাছে যাই, এর আগে পর্যন্ত আমাদের তরুণ নির্মাতাদের ধারণা ছিল এনটিভি যেহেতু বাংলাদেশের টপ তিনটা চ্যানেলের একটা, ওখানে অনেক ব্যুরোক্রেসির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আমি হেঁটে গিয়ে উনার রুমে ঢুকে গেলাম। গিয়ে জানালাম আমি আশফাক নিপুণ, আপনাকে একটা গল্প শোনাতে চাই। উনি খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনলেন। এরপর খুবই আগ্রহ নিয়ে বললেন, আপনি জিনিসটা বানিয়ে নিয়ে আসেন, আমরা চালাব। এমনও না দেখব... রেখে যান। প্রথম পরিচয় ও কাজে সরাসরি বলেন, বানিয়ে নিয়ে আসেন আমরা চালাব...

২০১৩ সালে এনটিভির সঙ্গে আমার দ্বিতীয় কাজ। ‘ল্যান্ডফোনের দিনগুলিতে প্রেম’। জানুয়ারিতে আমি গেলাম। এক লাইনে উনাকে আইডিয়াটা শোনানো মাত্র উনি রাজি হয়ে গেলেন। উনি বললেন, আমি এটা কনফার্ম চালাব, আপনি শুধু বানিয়ে নিয়ে আসেন। তরুণ নির্মাতাদের তাঁর এই যে উৎসাহ দেওয়া, এটা আমাকে মুগ্ধ করে। সাধারণত হয় কি, একটু বেশি সিনিয়র হলে তরুণদের আইডিয়া নিতে চান না। কিন্তু উনি এ ক্ষেত্রে উল্টো। এরপর থেকে করোনার আগ পর্যন্ত প্রতি ঈদে আমার কাজ গেছে এনটিভিতে। শুধু এই লাইনে আইডিয়া শোনাতাম। আমার মতো অনেক তরুণকে উনি যেভাবে পরিচর্যা করার চেষ্টা করেছেন, আমাদের জেনারেশনের প্রচুর ফিল্ম মেকার আছেন, যাঁরা আসলে এনটিভিতে কাজ করে লাইমলাইটে এসেছেন। বাংলাদেশে ৪০টার মতো টিভি চ্যানেল, গেল বছর কামাল ভাই যখন মারা গেলেন, যত মানুষ শোক জানিয়েছেন, দেশের ইতিহাসে কোনো টেলিভিশনের অনুষ্ঠানপ্রধানের জন্য হয় না। কামাল ভাই, আপনি আমার ক্যারিয়ারে একটা দিকপালের মতো ছিলেন। আপনি না থাকলে আমার মতো অনেকেই এখন যে অবস্থানে আছি, সেখানে আসতে পারতাম না।

মাবরুর রশিদ বান্নাহ, নির্মাতা

একজন মোস্তফা কামাল সৈয়দ আমার কাছে অনেক বড় কিছু। যদি বলি, উনি আমার কাছে একজন বটবৃক্ষ। উনি আমার জন্য গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল ছিলেন। জানি না... উনি অনেকের মতো আমাকেও মনে করেছিলেন আমি এখানে কাজ করার যোগ্য। যখন আমি হতাশায় নিমজ্জিত ছিলাম, আমাকে কেউই কাজ দিচ্ছিল না বলতে গেলে, ঠিক সে সময় এনটিভিতে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘ফ্লাশব্যাক’ নাটক দিয়ে আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়। সেই কাজটি উনি অ্যাপ্রুভ করলেন, ওয়ার্ক অর্ডার দিলেন... আমার জীবনের প্রথম কাজ। এনটিভির মতো একটা চ্যানেলে বাংলাদেশের বিখ্যাত একটা চ্যানেলে... সবচেয়ে রুচিশীল একটা চ্যানেলে সুযোগ পেলাম। শুধু সুযোগ পেলাম না, বিশেষ দিনে এটার জন্য আমি আমার আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই, আমার পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই। তেমনই ধন্যবাদ জানাই আমার পরিবারের মতো মোস্তফা কামাল সৈয়দ স্যারকে। স্যার যদি আমাকে সুযোগটা না দিতেন, তাহলে আমি আমার আজকের অবস্থানে থাকতে পারতাম কি না জানি না। স্যার বিভিন্ন সময়... আমার প্রথম কাজ... আমার প্রথম ঈদের কাজ সব স্যারের হাত ধরে। এ জন্য স্যারের কাছে কৃতজ্ঞতা ভালোবাসা প্রকাশ করার কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। আমি আমার দর্শকদের বলতে চাই, আমার গল্পনির্ভর যে কাজ, তার পেছনে মোস্তফা কামাল সৈয়দ স্যারের অবদান অনেক। স্যার এসব গল্পকে অনুপ্রেরণা দিতেন। স্যারের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা কোনোদিন কম হবে না। স্যারকে ভালোবাসি, ভালোবেসেই যাব। স্যারের জন্য অনেক অনেক দোয়া।

হাবীব শাকিল, নির্মাতা

সময়টা ২০১৬। ফিল্ম বানানোর ভাবনা থেকে ঢাকায় আসার পর আমার বানানো প্রথম নাটক ‘মাস্টার প্ল্যানার’ জমা দিলাম এনটিভি চ্যানেলে। সেই অর্থে কাউকেই তেমন চিনতাম না। নাটক জমা দেওয়ার কিছুদিন পর ফোন আসল এনটিভি থেকে। জানানো হলো, আপনার সাথে মোস্তফা কামাল সৈয়দ স্যার কথা বলবেন। আমি তাড়াতাড়ি এনটিভিতে চলে গেলাম। এই মানুষটা আমাকে দেখেই বললেন, আপনি সিনেমা বানালে ভালো করবেন। আপনার কাজটা ভালো হয়েছে। নাটকটা আমরা ঈদে চালাতে চাই। আহা, সে থেকেই আমার সাথে এনটিভির সম্পর্ক। সে বছর ঈদে ‘মাস্টার প্ল্যানার’ নাটকটি আলোচিত হলো। ঈদের সেরা দশ কাজের মধ্যে জায়গা করে নিল আমার নাটক। এর পর একে একে অনেক সময় গেল, অনেক কাজ হলো। আমার ক্যারিয়ারের যতটুকু প্রাপ্তি, তার মধ্যে স্যারের অবদান অনেক। বিভিন্ন সময়ে নাটক নিয়ে যে উপদেশ তিনি দিয়েছেন, তা-ই এখন অভিজ্ঞতার ঝুলি। উনি আসলে তরুণ নির্মাতাদের জন্য একটি ইনস্টিটিউট ছিলেন। উনি আছেন, থাকবেন আমাদের তরুণদের কাজের মধ্যে।

আশনা হাবিব ভাবনা, অভিনেত্রী

কামাল আঙ্কেলকে নিয়ে বলতে গেলে আমি বেশ ইমোশনাল হয়ে যাই। আমার সঙ্গে উনার দেখা হয়েছে একদিন মাত্র। তবে আমি উনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ এই কারণে, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই স্বার্থ বুঝে মানুষকে কাজ দেয়। আমি কিন্তু এজেন্সি কিংবা প্রযোজকদের পছন্দের অভিনেত্রী হতে পারিনি, পরিচালকেরা আমাকে কাজে নক করে। এই জায়গা থেকে কামাল আঙ্কেল এমন একজন মানুষ ছিলেন, উনি পরিচালকদের অনেক বলতেন আমার কথা। ভাবনা ভালো অভিনয় করে, ওকে নাও। আমাকে পরিচালকেরা ফোন করে বলতেন, কামাল স্যার তোমাকে নিতে বলেছেন। এই চরিত্রের জন্য তুমি ভালো করবে, এটা স্যার বলেছেন। উনার ফোন নাম্বারও কিন্তু আমার কাছে ছিল না, কখনও ফোনও করিনি। তো আমার একটা আক্ষেপ, একটা মানুষ আমার অভিনয় পছন্দ করে আমাকে অনেক কাজ দিয়েছেন। আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকার পরও। তাঁকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারিনি কখনও, এই আক্ষেপ আমার খুব কাজ করে। তাঁকে ধন্যবাদ জানানো হলো না আমার।