ফিল্ম রিভিউ

‘এককথায় ভালো চলচ্চিত্র মাটির প্রজার দেশে’

Looks like you've blocked notifications!

চলচ্চিত্রের একাডেমিক ভাষা প্রকাশের এক অনন্য উদাহরণ ‘মাটির প্রজার দেশে’। বিজন ইমতিয়াজ পরিচালিত ছবিটি বিশ্বের ২০টির বেশি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছে। দেশে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে গত ২৩ মার্চ।

ছবিটি দেখার পর শুধু মনে হয়েছে যে দেশের বাইরে থেকে কীভাবে দেশকে ও দেশের মানুষকে ভেতরে লালন করা যায়। পরিচালক বিজন ইমতিয়াজের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে তাঁর গল্প নির্বাচন ও বলার ধরনের প্রশংসা না করে উপায় নেই। ছবিতে অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেছে ক্যামেরার ফ্রেম, লোকেশন, আলোকসম্পাত, সম্পাদনা ও আবহসংগীত।

অনেক দিন পর বাংলা চলচ্চিত্রের পর্দায় গ্রামের খুব সুন্দর দৃশ্য, যেমন—গমক্ষেত, বাঁশঝাড়, শুকনো পাতা ছড়ানো আমতলা, সবকিছু দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছে। পরিচালকের মসজিদে দৃশ্য ধারণের কাজটি ছিল খুব সাহসী পদক্ষেপ। অভিনয়ে এই চলচ্চিত্রের সবাই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। খুব অল্প সময়ও যে পর্দায় থেকেছেন, তিনিও তাঁর সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা দেশের বাইরের চলচ্চিত্রে চলমান থাকলেও আমাদের দেশে এমন উদাহরণ বিরল।

প্রতিটি চরিত্রের পরিণতি এই ছবির একটি চ্যালেঞ্জ, যা পরিচালক সফল করে নিয়েছেন। রোকেয়া প্রাচী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রমিজ রাজু, রুমা, কচি খন্দকার, আবদুল্লাহ রানা, ইকবাল হোসেন, শিমু তাঁদের অভিনয় ও অল্প সময়ে খুব শক্তভাবে পর্দায় তাঁদের বিচরণই প্রমাণ করে, তাঁরা কতটা শক্তিশালী অভিনয়শিল্পী। ছোট ছোট অনেক গল্প দিয়ে খুব সুন্দরভাবে পর্দায় গ্রামবাংলার সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন পরিচালক।

তবে কিছু দৃশ্য আমরা অনেক চলচ্চিত্রেই এর আগে দেখেছি, যেমন বিয়ের জন্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়ে দেখা, যৌতুকে সাইকেল নেওয়া। পরিচালক চাইলে অন্যভাবে এই দৃশ্যগুলো দেখাতে পারতেন। বাড়ি থেকে যখন লক্ষ্মী পালকিতে করে চলে যাচ্ছে, ঠিক ওই সময় জানালার শিক ধরে থাকা বৃদ্ধার একটি শটই লক্ষ্মীর ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে বা পরিণতি কী, তা আমাদের বুঝিয়ে দেয়।

বিয়ের আগে ও পরে লক্ষ্মীর অভিনয়ের পরিবর্তন মুগ্ধ করেছে। জামালের চরিত্রটি প্রতীকী আমাদের গ্রামবাংলার অনেক শিশুর মতো। নিয়মের বেড়াজালে যাদের আমরা আটকে থাকতে দেখি। মায়ের ওপর শুকনো পাতা ঢেলে দেওয়ার পর মায়ের আঁচল থেকে টাকা বের করার দৃশ্য অনেককে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। কিছু প্রতীকী শট এই চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেমন—মুরগির কাটা ঝুলে থাকা মাথা, মাছের আধকাটা শট এমন অনেক কিছুর বুনন সমৃদ্ধ হয়েছে ছবিটিকে।

জামালের মা চরিত্রে চিন্ময়ী ও রাজ্জাক হুজুর চরিত্রটি দর্শকের অনেক দিন মনে থাকবে এবং এই চরিত্র দুটির রসায়ন ছিল পরিচালকের জন্য খুব বড় চ্যালেঞ্জ। মনির আহমেদ শাকিল খুব সাহসী ভূমিকায় নিজেকে আবারও প্রমাণ করেছেন। চিন্ময়ীর নির্লিপ্ত অভিনয়, চরিত্র ধরে রাখার ক্ষমতায় তিনি ছিলেন অসাধারণ। তবে পুরোনো পেশায় ফিরে যাওয়ার সময় পরিচালক চিন্ময়ীকে ওই রকম বাজারের ভেতর দিয়ে না নিয়ে গেলেও পারতেন। ব্যাপারটি আরোপিত মনে হয়েছে। রাজ্জাক হুজুর নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর পবিত্র কোরআনের কপি সংবলিত শটটি দিয়ে এলে আমরা ফিরে গিয়েছি মানবজীবনের মূল দর্শনে। কোরআনের আলো থেকে নিজেকে আলোকিত করে রাজ্জাক হুজুরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল অসাধারণ। সূর্য উদয়ের সময় রাজ্জাক হুজুরের সংলাপ আমার কানে এখনো লেগে আছে, ‘পরকালে বিচার হবে আত্তার, দেহের নয়।’

জামালকে সন্তান পরিচয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর মধ্য দিয়ে গল্পের যে ইতি টেনেছেন পরিচালক, তা আমাদের উন্নয়নশীল দেশের বৈশিষ্ট্য বহন করে। ছোট ছোট কিছু অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়লেও সামগ্রিক নির্মাণে এককথায় ভালো চলচ্চিত্র মাটির প্রজার দেশে। ৮৮ মিনিটের সিনেমায় কয়েকটি গল্পের এমন সফল সংমিশ্রণ উজ্জ্বল হয়ে থাকবে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।

লেখক : নাট্য পরিচালক